সিরিয়া ফেরত সৌদি প্রবাসী এক বাংলাদেশি জঙ্গিকে আটক করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। মুতাজ আব্দুল মজিদ ওরফে কফিল উদ্দিন বেপারী (৩৩) নামের এই ব্যক্তি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট-আইএসের হয়ে সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন।
তাঁকে রোববার রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশানাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসি। পরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া ও জনসংযোগ) মাসুদুর রহমান বেনারকে বলেন, “এই ঘটনায় মামলা হয়েছে। মুতাজ সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি চারদিনের রিমান্ডে আছেন।”
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এসআই আশরাফুল হক বাবু বাদী হয়ে এই মামলাটি দায়ের করেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেন উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই আব্দুল্লাহ ইবনে সাইয়ীদ। মুতাজ ছাড়াও এ মামলায় অজ্ঞাত ৫-৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে মুতাজের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধ করা এবং ঢাকায় এসে সরকার উৎখাতসহ নাশকতার পরিকল্পনার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, এভাবে সিরিয়া ফেরত আইএস জঙ্গিদের দেশে ফেরত আসার বিষয়টি উদ্বেগের। আন্তর্জাতিক এই জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যরা ফিরে এসে দেশীয় জঙ্গিদের নিয়ে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করতে পারে বলে আশঙ্কা তাঁদের।
মেজর জেনারেল (অব) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার বেনারকে বলেন, সিরিয়া থেকে জঙ্গি ফিরে আসার বিষয়টি ভীষণ উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ এবং ভীতিকর। সিরিয়া থেকে আইএস জঙ্গিরা যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালানো শুরু করেছিল তখন থেকেই এই আশঙ্কা ছিল।
“দেশে ফিরে আরো অনেক লোককেই জঙ্গিরা দলে ভিড়াবার চেষ্টা করতে পারে। বাংলাদেশের ভিতরে যে জঙ্গিরা আছে তাদের সাথে যোগসাজশ করে জঙ্গি তৎপরতা বাড়ানোর পরিকল্পনাও করতে পারে,” মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন।
মোহাম্মদ আলী শিকদার মনে করেন, যেহেতু তারা সিরিয়াতে ছিল সুতরাং তাদের সাথে অন্য দেশের জঙ্গিদেরও যোগাযোগ থাকতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি আরো সিরিয়াসলি দেখা উচিত যাতে বড় ধরনের কোনো বিপদ ঘটাতে না পারে।
এদের দেশের ফেরা ঠেকাতে বিমানবন্দর এবং স্থল সীমান্তে কড়া নজরদারির ব্যবস্থার পাশাপাশি অন্য দেশের সাথে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক তৈরি করে আমাদের দেশের জঙ্গিরা কোথায় যাচ্ছে বা অবস্থান করছে তা খোঁজ রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ থেকে ঠিক কতজন সিরিয়া গিয়েছে সে পরিসংখ্যান না থাকলেও এই সংখ্যা কমপক্ষে ৪০ জন বলে জানিয়েছে পুলিশ। এদের সম্পর্কে বিমানবন্দরগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মুতাজ ছাড়া সিরিয়া ফেরত কারো দেশে ফেরার কোনো খবর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নেই।
এর আগে ২০১৫ সালের ১৫ মে গাজী কামরুস সালাম সোহান নামে একজন প্রকৌশলী সিরিয়া থেকে তুরস্ক হয়ে ঢাকায় পৌঁছান। দশদিন নিজের বাড়িতেই ছিলেন। পুরনো কর্মস্থলে গেলে তাঁকে সাদা পোষাকে একদল লোক তুলে নিয়ে যায়। একবছরেরও বেশি সময় পর ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর র্যাব মোহাম্মদপুর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায়। এখনও কারাগারে আছেন তিনি।
দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট

পুলিশ জানায়, মুতাজ বাংলায় কথা বলতে পারেন না। তিনি শুধু আরবী ও ইংরেজীতে কথা বলেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মুতাজ জানিয়েছেন তিনি বংশানুক্রমে বাংলাদেশের নাগরিক হলেও তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সৌদি আরবে। বাবা বাংলাদেশি ও মা পাকিস্তানি। মুতাজের বাবা আবদুল মজিদ ব্যাপারী মারা গেছেন। সৌদিতে তাঁর ভাই-বোনেরা আছেন। বাংলাদেশে তাঁর বাড়ি শরীয়তপুর জেলার সখিপুরে।
সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে ২০১৪ সালে বাংলাদেশি পাসপোর্ট করেন মুতাজ। ওই পাসপোর্ট ব্যবহার করে ২০১৬ সালে সৌদি আরব থেকে তুরস্কে যান। সেখানেই আইএস এর সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। এরপর সিরিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সৌদি আরবে ফেরত যান। কয়েক দফা সৌদি-তুরক্ত যাতায়াতের পরে ২০১৮ সালের মে মাসে তুরস্ক হয়ে সিরিয়া গিয়ে আইএস এর সদস্য হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন তিনি।
নব্য জেএমবির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা
মামলার এজাহারে আরো বলা হয়, সিরিয়ায় আইএস এর পতনে পর মতাজ তুরস্কে এসে আত্মগোপন করে সেখান গ্রীস হয়ে অন্য কোনো ইউরোপীয় দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। তবে তুরস্কের পুলিশের সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানের মুখে এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে চলে আসেন।
পুলিশ বলছে, মুতাজের দেশে ফেরার খবর আগেই জানত পুলিশ। পরে গত ৫ মে পুলিশ উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টর ১০ নম্বর সড়কের বায়তুন নূর জামে মসজিদের সামনে থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ জানায়, মুতাজের উদ্দেশ্য খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা ও বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করা। তিনি বাংলাদেশে নব্য জেএমবির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও করছিলেন।
বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, এদেশে নব্য জেএমবি আইএসের মতাদর্শ অনুসরণ করে থাকে। এই মামলার এজাহারেও উল্লেখ রয়েছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মুতাজও নব্য জেএমবির ভাবধারায় বিশ্বাসী বলে স্বীকার করেছে।
এজাহারে আরো বলা হয়, মুতাজ নব্য জেএমবিদের সঙ্গে মিলে সংগঠনের সদস্য বৃদ্ধি, সরকারকে উৎখাত করে খিলাফত প্রতিষ্ঠা, সংগঠনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণ করাসহ দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি পরিকল্পনা করছিল।