হলি আর্টিজান মামলার শুনানিতে এক কিশোর শনাক্ত করল দুই আসামিকে

প্রাপ্তি রহমান
2019.07.16
ঢাকা
190716_Gulshan_attack_1000.JPG ঢাকায় হলি আর্টিজান হামলায় নিহতদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে শোকাতুর এক স্বজন। ৪ জুলাই ২০১৬।
[রয়টার্স]

হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার বিচার শুরুর ২৯ তম দিনে এই প্রথম দুই আসামি শনাক্ত হলেন। মঙ্গলবার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারকের নির্দেশে তানভীর কাদেরী ও আবেদাতুন ফাতেমা আশা দম্পতির কিশোর পূত্র কাঠগড়ায় থাকা আসামি রাশেদ ওরফে ‘র‍্যাশ’ ও ‘জাহাঙ্গীর আলম’কে শনাক্ত করে।

কিশোরটি সাক্ষ্য দেয় প্রায় এক ঘণ্টা ধরে। সে জানায়, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও তাঁদের সহযোগীরা ছাড়াও ওই দুই আসামি নিয়মিত তাদের বাসায় যাওয়া–আসা করত। আসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র‍্যাশ উত্তরা, বসুন্ধরা, মিরপুর ও আজিমপুরের বাসায় গিয়েছে। আর জাহাঙ্গীর আলম স্ত্রী–পুত্র সহ তাদের বসুন্ধরার বাসায় এসে উঠেছিলেন।

সাক্ষ্য শেষে বিচারক মো মজিবুর রহমান কিশোরের কাছে প্রশ্ন রাখেন, ‘তুমি যাদের কথা বলছ, তাদের কেউ এখানে আছে?’ জবাবে কিশোর জানায়, ‘র‍্যাশ আংকেল সাদা শার্ট পরে আছে, জাহাঙ্গীর আঙ্কেল কালো টি শার্ট।’ এ সময় কাঠগড়ায় থাকা দুই আসামিকে অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল।

র‍্যাশের বাবা আবদুস সালামকেও গতকাল খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘ওই একটাই ছেলে আমার।’

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের হওয়া এই মামলার কৌঁসুলি জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, কিশোরটির সাক্ষ্য মামলার বিচারকে সহজতর করবে।

“ছেলেটি হামলার আগে পরে সংগঠনটির তৎপরতা, সম্পৃক্ততার বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছে। এবং সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার এই মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামিকে সে শনাক্ত করতে পেরেছে, এরপর বিচার নিশ্চিতে আর কিছু লাগে?” জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন।

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে জঙ্গি হামলায় তানভীর কাদেরী অর্থায়ন করেছিলেন এবং মূল পরিকল্পক তামিম চৌধুরীসহ শীর্ষ নেতাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। তদন্তকারী সংস্থা কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম জানায়, হামলাকারী পাঁচ তরুণ তানভীর কাদেরী ও আবেদাতুন ফাতেমা আশার বসুন্ধরার বাসা থেকে হামলার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল।

২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে পুলিশি অভিযানে তানভীর কাদেরী নিহত হন। ওই দিনই আস্তানা থেকে আবেদাতুন ফাতেমা আশা ও তাঁর ছেলেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ দেশি–বিদেশি ২২ জন নাগরিক নিহত হন। এই মামলায় তানভীর কাদেরী ও আবেদাতুন ফাতেমার ১৬ বছর বয়েসি ছেলে ৬৬ তম সাক্ষী ছিল। এই হামলার বিভিন্ন পর্যায়ে ২১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ৮জন আসামি জীবিত ও নিয়মিত আদালতে হাজির থাকছেন।

দীর্ঘ সাক্ষ্যে যা বলেছে কিশোর

কিশোর বলে তার বাবা তানভীর কাদেরী হজ করে আসেন ২০১৪ সালে। তার বাবা–মা ও যমজ ভাইসহ সে তখন উত্তরায় থাকত। তার যমজ ভাই পরে আশকোনার সূর্য ভিলায় পুলিশি অভিযানে নিহত হয়। ওই সময় সে ছিল কিশোর সংশোধনাগারে আর তার মা কারাগারে।

কিশোর তার ভাষ্যে তানভীর কাদেরীর জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া থেকে শুরু করে আজিমপুরে পুলিশি অভিযানে নিহত হওয়ার সময় পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ আদালতকে অবহিত করে। সে বলে, তার বাবা ফজরের নামাজ পড়ে জগিং করত। তাঁর সঙ্গে থাকতেন মুসা ও মেজর জাহিদ। এর মধ্যে একদিন তাদের বাবা হিযরতের পরামর্শ দেন মা কে। তিনি প্রথমে রাজি ছিলেন না। পরে রাজি হন। তারাও রাজি হয়।

তানভীর কাদেরীকে উদ্ধৃত করে কিশোর বলে, ‘আব্বু বলে, আমরা এক জায়গায় যাব, যেখানে খাওয়া দাওয়ার কষ্ট হবে, স্কুল–খেলার মাঠ নাও থাকতে পারে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা খুশি হবেন।’ এরপরই প্রথম সে আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে র‍্যাশকে তাদের বাসায় দেখে। ওই দিন তাদের বাসায় মুসা ও মেজর জাহিদও এসেছিলেন।

উল্লেখ্য, কাউন্টার টেররিজমের তদন্তে অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে মুসার ভূমিকা এবং এক সময় জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)র আমিরের দায়িত্ব পালন করেছেন বলে বেরিয়ে এসেছে। মেজর জাহিদ হামলাকারীদের সমরাস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন।

জঙ্গিসংগঠনে যুক্ত হওয়ার পর তানভীর কাদেরী পরিবারের সদস্যদের জানান , তাঁরা মালয়েশিয়া চলে যাচ্ছেন। ‘সেটল’ হয়ে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। মালয়েশিয়ার পরিবর্তে উত্তরার বাসা থেকে তারা সবাই বসুন্ধরায় এসে ওঠে। সেখান শীর্ষস্থানীয় সব নেতাই আসতেন ও পালাক্রমে থাকতেন। কিশোর আরও জানায়, আবেদাতুন ফাতেমা আশার সঙ্গে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী থাকতেন। আর সে তার বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে এক কক্ষে থাকত।

কিশোর তার সাক্ষ্যে বলেছে, বসুন্ধরার বাসায় ‘চকলেট আংকেল’ (বাশারুজ্জামান চকলেট) প্রথমে তিনজন ও পরে দুজনকে নিয়ে আসে। তাদের সাংগঠনিক নাম ছিল সাদ, মামুন, শুভ, আরিফ ও ওমর। তাদের বাসার সবচেয়ে বড় কক্ষে তামিম চৌধুরী ওই পাঁচজনকে নিয়ে থাকতেন। তাঁর কক্ষে প্রবেশ নিষেধ ছিল। একদিন ইফতার দিতে গিয়ে সে দেখে, একজন শিরিষ কাগজ দিয়ে চাপাতি ধার করছে।

ওই সময়ে তানভীর কাদেরী জানতে চান, ‘এসব কেন’? জবাবে তামিম চৌধুরী বলেন, ‘বড় একটা অপারেশন আছে।’

হলি বেকারিতে হামলার প্রস্তুতি

আদালতে কিশোর বলে, ‘একদিন চকলেট আংকেল (বাশারুজ্জামান চকলেট, চাঁপাইনবাবগঞ্জের অভিযানে নিহত) পাঁচটি ব্যাগ নিয়ে আসে। এর কয়েকদিন পর চকলেট আংকেল সারোয়ার নামে এক আংকেলকে বাসায় নিয়ে আসে। আলোচনা করে তারা চলে যায়। তারপর তামিম আংকেল আবার তাদের জন্য পাঁচ সেট নতুন জামা আনতে বলল।’

ঘটনার দিন পাঁচজনের মধ্যে তিনজন প্রথমে ও পরে আরও দুজন বের হয়। তারা ওই কিশোরদের বলে যায়, ‘জান্নাতে দেখা হবে।’ ওইদিনই তারা তামিম চৌধুরীর নির্দেশে বসুন্ধরার বাসা ছেড়ে মিরপুরের পল্লবীর আরিফাবাদে চলে আসে। তার বাবা বিডিনিউজ ২৪ সহ বিভিন্ন নিউজ সাইটে গিয়ে হলি বেকারিতে হামলার খবরাখবর রাখছিলেন।

মামলা থেকে সরে দাঁড়ালেন আসামিপক্ষের আইনজীবী

সাক্ষ্য শেষে আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে র‍্যাশের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ ও জাহাঙ্গীর আলমের আইনজীবী সিতারা ফওজিয়া সালাম কিশোরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

ফারুক আহম্মেদ বলেন, কিশোরটি অপর একটি মামলায় আসামি এবং ওই মামলায় সে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। তিনি ওই মামলায় দেওয়া তার সাক্ষ্যের প্রসঙ্গ তুললে বিচারক প্রাসঙ্গিক বিষয়ে জেরা করতে বলেন।

এর কিছুক্ষণ পরই ফারুক আহম্মেদ আসামিদের পক্ষে মামলা না লড়ার আবেদন জানান। রাত পর্যন্ত তাঁর আবেদন গৃহীত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে ফারুক আহম্মেদ বলেন, “আসামির পরিবারের লোকজন যোগাযোগও করছে না, কাগজপত্রও ঠিকঠাক দিচ্ছে না। তাই সরে দাঁড়ানোই বাঞ্ছনীয়।”

আদালত আসামিপক্ষের স্বজনদের ডেকে আইনজীবী চূড়ান্ত করার অনুরোধ করেন। নইলে রাষ্ট্র তাঁদের জন্য আইনজীবী নিয়োগ দেবেন বলে জানান।

গতকাল আরও সাক্ষ্য দেন ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজানে জিম্মি থাকা তাহমিদ হাসিব খানের বন্ধু ফাইরুজ মালিহা। তিনি বলেন, ঘটনার রাতে তাঁরা লনে বসে আইসক্রিম খাচ্ছিলেন। সন্ত্রাসীরা রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢুকে পড়েই আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে গুলি ছোড়ে ও কোপায়।

সে রাতে তাদের দিকে নিবরাস অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসে। বাঙালি ও মুসলমান পরিচয় জানতে পেরে বলে, তাঁদের কোনো ভয় নেই। তাঁদের ক্ষতি হবে না। কিন্তু পরদিন ভোরে তারাই তাহমিদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। রাতভর তারা লাশগুলো উল্টে পাল্টে দেখে।

প্রসঙ্গত, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে প্রতিবেদনে কিশোরের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।