জঙ্গিবাদ দমনে জেলা প্রশাসকদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা
2017.07.25
ঢাকা
জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দূরীকরণে আরও সতর্কতার সঙ্গে এবং কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করতে জেলার নির্বাহী প্রধান ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার থেকে ঢাকায় শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এই নিদের্শনা দেন।
গত বছর গুলশানের হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর এই নিয়ে টানা দুই বছর জেলা প্রশাসক সম্মেলনে জেলার উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়গুলোকে ছাপিয়ে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
“গত বছর জঙ্গিবাদ দমনে জেলা প্রশাসকদের যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তার ফল পাওয়া যাচ্ছে,” বেনারকে বলেন সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন।
এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বেনারকে বলেন, “জেলা প্রশাসকেরা জেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তাঁদের সঙ্গে সকল মহলের যোগাযোগ থাকে। তাই জঙ্গিবাদ দমনে তাঁরাও বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন।”
“আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন, ইতিমধ্যে অনেক জঙ্গিই আত্মসমর্পণ করে সঠিক পথে ফিরে এসেছে। বিভিন্ন এলাকাবাসী নিজ থেকেই জঙ্গিদের তথ্য শেয়ার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করছে। এসবই স্থানীয় পর্যায়ের উদ্যোগের সুফল,” বলেন আলী হোসেন।
“আন্তরিকভাবে করলে ডিসিরা বিভিন্ন গোষ্ঠী বা বিভিন্ন জনমতের লোকজনকে একত্রিত করে তাঁদের দিয়ে জঙ্গিবাদ দমনে ভূমিকা রাখতে পারেন,” বেনারকে বলেন জঙ্গিবাদ বিশ্লেষক সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
জঙ্গিবাদ নির্মূলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, গ্রামের মুরুব্বি, নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী, নারী সংগঠক, আনসার-ভিডিপি, গ্রাম পুলিশ, এনজিও কর্মীসহ সমাজের সবাইকে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। জেলা প্রশাসকদের করণীয় হিসেবে মোট ২৩ দফা নির্দেশনা প্রদান করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, গত বছর প্রথমবারের মতো জেলা প্রশাসক সম্মেলনে জঙ্গিবাদ দমনের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসনের আওতায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী কমিটি গঠন করতেও বলা হয়।
“জঙ্গিবাদ দমনের লক্ষ্যে যে কমিটিগুলো গঠন করা হয়েছিল, নিয়মিত সেগুলোর কার্যক্রম চালু রয়েছে। প্রতি মাসে কমিটির বৈঠক বা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়,” বেনারকে বলেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম মজুমদার।
জেলা প্রশাসকদের প্রতি আরও যেসব নির্দেশনা
নিয়মিত বহুবিধ দায়িত্বের পাশাপাশি জেলা প্রশাসকদের প্রতি ২৩টি বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করার পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে জোর দিয়েছেন তিনি।
গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসকদের আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “সাধারণ মানুষকে সহজে সুবিচার প্রদান ও আদালতে মামলার জট কমাতে গ্রাম আদালতগুলোকে কার্যকর করতে হবে। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছাতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিকাশে নেতৃত্ব দিতে হবে।”
শিক্ষার সর্বস্তরে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার প্রতিও গুরুত্ব দেন শেখ হাসিনা।
নির্দেশনায় বলা হয়, ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সরকারি ভূমি রক্ষা, কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধিতে সার, বীজ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নির্বিঘ্ন করা, পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনাকে জনপ্রিয় করতে উদ্যোগী হতে হবে। ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বাজারজাতকরণের মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও এসডিজির সফল বাস্তবায়নে মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় প্রশমনে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে করতে হবে। পরিবেশ রক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এই সংক্রান্ত আইন ও বিধিবিধানের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।”
নির্দেশনায় শিল্পাঞ্চলে শান্তি রক্ষা, পণ্য পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানি নির্বিঘ্ন করা এবং পেশিশক্তি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাস নির্মূল করার কথা বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ভোক্তা অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অপচেষ্টা দমন করতে হবে। নারী উন্নয়ন নীতি সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্ব দেন। এ ছাড়া কঠোরভাবে মাদক ব্যবসা, মাদক চোরাচালান এবং এর অপব্যবহার বন্ধের কথাও বলেন তিনি।
সরকারি ভূমি রক্ষার পাশাপাশি পার্বত্য জেলাসমূহের উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণ ও এ অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের নির্দেশনাও দেওয়া হয় জেলা প্রশাসকদের।
এসবের বাইরে নিজস্ব জেলাভিত্তিক সমস্যা চিহ্নিত করে এগুলো সমাধানের উদ্যোগ এবং নদী ভাঙনের শিকার ও গৃহহীনদের ঘর-বাড়ি তৈরি করে দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণেও নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।