হলি আর্টিজান মামলা: গ্রেপ্তারের আগে গুম হওয়ার দাবি সাত আসামির

প্রাপ্তি রহমান ও জেসমিন পাপড়ি
2019.11.18
ঢাকা
191118_Holy_artisan_verdict_date_1000.jpg গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার আসামিদের ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ১১ নভেম্বর ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুর এক বছরের মাথায় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা মামলার রায় ঘোষণা হতে যাচ্ছে আগামী ২৭ নভেম্বর। অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্য, জেরা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রোববার রায় ঘোষণার তারিখ জানান সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবর রহমান।

তবে মামলায় গ্রেপ্তারকৃত আট আসামির সাতজনই অভিযোগ করেছেন, গ্রেপ্তার দেখানোর আগে দীর্ঘ সময় তাঁদের গুম করে রাখা হয়েছিল।

রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসামিদের অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত দাবি করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রার্থনা করা হয়। অন্যদিকে আসামিদের অভিযোগ বিবেচনায় নিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী আদালতের কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি গোলাম সারওয়ার খান বেনারকে বলেন, “আসামিদের গুমের অভিযোগ অসত্য। তাঁদের যেখান থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, তাঁরা সেখান থেকেই গ্রেপ্তার হয়েছেন।”

তাঁরা দায় এড়াতে বানিয়ে কথা বলছেন বলে দাবি করেন তিনি।

আদালতে গ্রেপ্তার আট আসামিরই সর্বোচ্চ শাস্তি হবে আশা করে তিনি বলেন, “এই মামলায় গ্রেপ্তার আট আসামির ছয়জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযানে নিহত তানভীর কাদেরীর ছেলে আসামি শনাক্ত করেছেন। আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নিজেদের ও অন্যদের সম্পৃক্ত করে বক্তব্য দিয়েছেন।”

সারওয়ার খান বলেন, “সন্দেহাতীতভাবে আসামিদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।”

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন বলেন, তিনি চান ন্যায়বিচার।

“মামলাটি পুরোপুরি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নির্ভর। গভীরভাবে অনুসন্ধান করা হয়নি। এক আসামির বক্তব্যের সঙ্গে অন্য আসামির বক্তব্যের মিল নেই। আমি আশা করি বিচারক এই বিষয়গুলো আমলে নেবেন,” বেনারকে বলেন দেলোয়ার।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “যেকোনো মামলার নির্মোহ তদন্ত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। এসব ক্ষেত্রে আটক রাখার পরে গ্রেপ্তার দেখালে আসামিরা দাবি করতে পারে তাদের ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের মনেও প্রশ্ন ওঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে।”

তিনি বলেন, “হলি আর্টিজানের এই হামলার সাথে সম্পৃক্ত অনেক আসামি বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছেন। এমন ঘটনা মামলাকে আরও দুর্বল করে দেয়।”

তবে সুবিচার হওয়া অত্যন্ত জরুরি উল্লেখ করে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “যারা জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হয়েছেন তাঁদের আর ফেরানো যাবে না। কিন্তু যারা এসব কাজে জড়াতে চাইছেন তাঁদের জন্য সতর্কবার্তা তৈরি করবে এই অপরাধের বিচার।”

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে অতর্কিত হামলা চালায় আইএসপন্থী জঙ্গিসংগঠন নব্য জেএমবির পাঁচজন সদস্য। দুই পুলিশ সদস্যসহ দেশি–বিদেশি ২৪ নাগরিক ওই হামলায় নিহত হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হন পাঁচ জঙ্গিও।

দু’বছর পর গতবছরের ২৩ জুলাই আলোচিত এই মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম। এর প্রায় চার মাসের মাথায় ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলাটির বিচারকাজ শুরু হয়।

এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ১১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে।

গুম থাকার অভিযোগ

এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে গত ৩০ অক্টোবর আদালত আসামিদের কাছে তাঁরা আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলতে চান কি না জানতে চায়। আট আসামির মধ্যে দুজন আসামি জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী ও মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান মৌখিকভাবে বক্তব্য দেন। বাকিরা লিখিতভাবে তাঁদের বক্তব্য বিচারককে জানান।

জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী বলেন, হলি আর্টিজানে হামলার আট দিন পরই তিনি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় চারমাস পর।

পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে এসব অভিযোগের কোনো জবাব দেয়নি। অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় তারা বলেছে, পরে আদালতে উপস্থাপন করা হলেও জাহাঙ্গীর অপরাধী। এ মামলায় গ্রেপ্তার প্রত্যেকেই অপরাধী।

জাহাঙ্গীর নিজেও আদালতে পৌনে এক ঘণ্টার বক্তব্যে তাঁর জঙ্গি জীবনের বিবরণ দেন। তিনি বলেন, হলি বেকারিতে হামলায় তিনি তিনটি ছেলে সরবরাহ করেছিলেন। তিনি ২০০২ সাল থেকে জেএমবির সঙ্গে যুক্ত এবং ২০১৪ সালে আইএসের প্রতি তার আনুগত্য স্বীকারের কথা আদালতকে জানান।

জঙ্গি নেতা তামিম চৌধুরী ও সারোয়ার জাহানের নির্দেশে তিনি ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আইএসের উত্তরবঙ্গ শাখার প্রধান ছিলেন। তার নেতৃত্বে রংপুরে জাপানি নাগরিক কোনিও হোশি, কুড়িগ্রামে মুসলিম থেকে খ্রিস্টান হওয়ায় হোসেন সরকারকে হত্যা করা হয়।

২০১৬ সালের ৩ মার্চ মারজানের মাধ্যমে রোহান ইমতিয়াজ ও শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বলের সাথে পরিচয়। যাদের নিয়ে কয়েকটি অভিযান চালান তিনি।

ওই তিনজনকে মেজর জাহিদ ও সারোয়ার জাহান মানিক প্রশিক্ষণ দেন বলেও উল্লেখ করেন জাহাঙ্গীর। উল্লেখ্য, হলি আর্টিজান হামলায় ওই তিনজন জড়িত ছিলেন।

আদালতের কাছে মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।

তিনি বলেন, আদালতে উপস্থাপনের আগে তিনি চার মাস গুম হয়েছিলেন। হলি আর্টিজানে হামলার সঙ্গে তিনি জড়িত নন।

“আমাকে মিথ্যে করি তুলে লি চার মাস গুম করে রাখল। ২০১৬ সালের অক্টোবরের ১ তারিখ ধইরেছে, মার্চের ১ তারিখ কোর্টে পাঠায়েছে। জোর করে জবানবন্দি নিয়েছে,” বড় মিজান আদালতকে বলেন।

তিনি আরও বলেন, তিনি একজন সাধারণ মাছ ব্যবসায়ী, জেএমবি চেনেন না, হলি আর্টিজান চেনেন না।

দুপক্ষের যুক্তিতর্ক

যুক্তিতর্কের মাধ্যমে মামলাটি বিচারের শেষ পর্যায়ে পৌঁছায়। প্রথমে রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে গত ৭ নভেম্বর। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি গোলাম সারওয়ার খান, নৃশংস হলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত আট জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড চেয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।

রোববার ছিল যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের শেষ দিন। এদিনে আসামি রাকিবুল ইসলাম ওরফে রিগ্যান, আসলাম হোসেন ওরফে র‍্যাশ, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও হাদিসুর রহমান ওরফে সাগরের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন। মামুনুর রশিদ রিপণের পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন খালেদুর রহমান রুমি। রাষ্ট্রপক্ষ বাকি তিনজনের জন্য আইনি সহায়তা দেন।

দেলোয়ার হোসেনের যুক্তি ছিল, রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলার তদন্তে খুব বেশি জোর দেয়নি। শুধু ছয়জন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর মামলাটি দাঁড় করিয়েছে। আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও একে অপরের দেওয়া তথ্যে কোনো মিল নেই।

“জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, শরিফুল তাঁর কাছে থাকা চারজন ছেলের মধ্যে হলি আর্টিজানে হামলার জন্য দুজনকে সরবরাহ করেন। তবে কোথায়, কার জিম্মায় সেই ছেলেরা ছিল বিষয়ে পুলিশ আর কোনো তথ্য দিতে পারেনি,” যুক্তিতর্কে জানিয়েছেন বলে তিনি বেনারকে জানান।

তিনি আরও বলেন, গাইবান্ধার সাঘাটার ফুলছড়িতে জঙ্গি প্রশিক্ষণে শরিফুল অংশ নিয়েছেন বলে এক আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। কিন্তু রাজীব গান্ধী তাঁর জবানবন্দিতে ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যাওয়ার কথা বললেও, শরিফুলের ব্যাপারে কিছু বলেননি।

এর জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি গোলাম সারওয়ার খান বলেন, প্রতিটি ঘটনাই সত্য। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ঢাকার বিভিন্ন বাসায় যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল সে বিষয়টি বাড়ির মালিকেরা আদালতে এসে সাক্ষ্য দিয়ে জানিয়েছেন।

“রিগ্যান জবানবন্দিতে প্রশিক্ষণ নিতে আসা লোকজনের মধ্যে হাসানের কথা বলেছে। এই হাসানই হাদিসুর রহমান ওরফে সাগর। অভিযোগপত্রে সে কথা বলা আছে,” গোলাম সারওয়ার খান যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বলেন।

তিনি আরও বলেন, রিগ্যান ২০১৬ সালের জুলাই এর শেষ সপ্তাহে পুলিশি অভিযানে গ্রেপ্তার হয়। যে বাড়ি থেকে সে পালাচ্ছিল সে বাড়ির মালিক আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। প্রতিটি জঙ্গি আস্তানার মালিকদের আদালতে হাজির করা হয়েছে। কোথাও কোথাও আসামিদের জবানবন্দিতে দিন–তারিখের এদিক–ওদিক আছে। কিন্তু এতে করে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

এদিকে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার আগেই মামলার অন্য আসামি মামুনুর রশিদ ওরফে রিপন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হন বলে দাবি করেন তাঁর আইনজীবী খালেদুর রহমান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।