হলি আর্টিজান হামলার বিচার শুরু
2018.11.26
ঢাকা

প্রায় আড়াই বছর আগে ঢাকার গুলশানে ঘটে যাওয়া দেশের ইতিহাসে সবচে নৃশংস হলি আর্টিজান জঙ্গি হামলার বিচার সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে।
সোমবার ঢাকার সন্ত্রাস-বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মুজিবুর রহমান এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে অভিযুক্ত আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বলে বেনারকে জানান ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
তিনি জানান, সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর জন্য ৩ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেছে আদালত।
অভিযুক্ত আট আসামির মধ্যে কারাগারে আটক ছয়জনকে চার্জ গঠনের সময় আদালতে উপস্থিত করা হয় এবং তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়।
ট্রাইব্যুনালের পেশকার আতাউর বেনারকে জানান, অভিযোগ গঠনের শুনানির সময় আদালতে উপস্থিত আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ‘ন্যায়বিচার’ প্রার্থনা করে।
পুলিশের চার্জশিট অনুযায়ী, আট আসামির সবাই ইসলামিক স্টেটের আদর্শের অনুসারী নব্য জেএমবির সদস্য। তাঁরা সবাই এই হামলার সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত।
আসামিদের মধ্যে কারাগারে আটকরা হলেন, নব্য জেএমবির সদস্য জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান এবং হাদিসুর রহমান সাগর।
অপর দুই আসামি শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপনকে পলাতক দেখিয়েই এ মামলার বিচার কাজ চলবে বলে জানায় আদালত।
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বেনারকে বলেন, “আজ আটজন আসামির মধ্যে ছয়জনকে আদালতে হাজির করা হয়। তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরাও এসেছিল। কিন্তু তারা কোনো আইনজীবী নিয়োগ করেনি।”
তিনি বলেন, “যে দুজন আসামি পলাতক আছে তাদের জন্য রাষ্ট্রপক্ষ আইনজীবী নিয়োগ করবে।”
“আগামী ৩ ডিসেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করে আদালত। আমরা ইতোমধ্যে প্রথম তিনজন সাক্ষীকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করেছি,” বলেন জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
হলি আর্টিজান হামলা ঠেকাতে গিয়ে জঙ্গিদের গুলিতে নিহত পুলিশ অফিসার রবিউল করিমের ছোট ভাই শামসুজ্জামান শামস বলেন, বিচার শুরু হওয়াতে তাঁরা খুশি।
তিনি বেনারকে বলেন, “আমার ভাতিজা বাবার সঙ্গে খুব হাসি-খুশি ছিল। কিন্তু তার বাবার মৃত্যুর পর খুব চাপা হয়ে বড় হচ্ছে। হয়তো তার বাবার হত্যাকাণ্ডের কারণ খোঁজে।”
শামস বলেন, “আমরা তার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে পারব না। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হলে আমরা তাকে বলতে পারব যে, তার বাবাকে যারা হত্যা করেছে তারা হাতে গোণা কিছু খারাপ লোকের কয়েকজন। এবং রাষ্ট্র তাদের বিচার করেছে।”
তিনি বলেন, “আর বিচার না হলে এই রাষ্ট্রের প্রতি তার কোনো আস্থা থাকবে না।”
‘তদন্তে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি সরকার’
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে পাঁচ সশস্ত্র জঙ্গি কূটনৈতিক পাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ঢুকে সেখানকার সকল অতিথিকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে।
এরপর সেখান উপস্থিত ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে জবাই ও গুলি করে হত্যা করে।
জিম্মিদের আটকের ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যে প্রায় সকলকে হত্যা করে জঙ্গিরা।
নিহতদের মধ্যে ছিলেন নয়জন ইতালির নাগরিক, সাতজন জাপানের নাগরিক, একজন ভারতীয় এবং তিনজন বাংলাদেশি।
জিম্মি সংকটের মধ্যেই ইসলামিক স্টেটের মিডিয়ায় ২০ জনকে হত্যার খবর প্রচার করে তারা ঘটনার দায় স্বীকার করে এবং হামলাকারীদের ছবি প্রকাশ করে।
পরদিন ২ জুলাই সকালে কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় হামলাকারী পাঁচ তরুণ; রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাজ ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল।
এই ঘটনায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাও জঙ্গিদের গুলিতে প্রাণ হারান।
পাঁচ জঙ্গি ও দুই পুলিশ অফিসারসহ ওই ঘটনায় মোট ২৯ জন নিহত হন।
তবে তদন্তে ওই হামলায় বিদেশি কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা পায়নি পুলিশ।
তদন্তে এই হামলার ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরী।
ঘটনার দুই মাস পর নারায়ণগঞ্জের একটি বাড়িতে দুই সহযোগীসহ পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন তামিম চৌধুরী।
হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২০০৯ সালের সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা হয়।
এই আইন অনুযায়ী বিচার শুরুর ছয় মাসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির সময় বেঁধে দেওয়া রয়েছে বলে বেনারকে জানান আইনজীবী প্রকাশ বিশ্বাস।
আট জঙ্গির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে বলে জানান আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্ত করে গত ২৩ জুলাই ওই হামলায় জড়িত ২১ জনকে চিহ্নিত করে জীবিত আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
চিহ্নিত বাকি ১৩ জন জঙ্গি বিভিন্ন অভিযানে নিহত হওয়ায় তাদের অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।
ওই ১৩ জনের মধ্যে রয়েছে পাঁচ হামলাকারী যারা কমান্ডো হামলায় নিহত হয়।
এ ছাড়া, বিভিন্ন ‘জঙ্গি আস্তানায়' র্যাব-পুলিশের অভিযানে নিহত আটজন হলেন- তামীম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান কবির তারেক, সারোয়ার জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান।
পুলিশের অভিযোগপত্রে বলা হয়, নব্য জেএমবির জঙ্গিরা ছয় মাস ধরে পরিকল্পনা করে ওই হামলা চালিয়েছিল।
দেশকে ‘অস্থিতিশীল’ করা এবং বাংলাদেশকে একটি ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ হিসাবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরাই ছিল এই হামলার উদ্দেশ্য।
গত ৮ আগস্ট এ মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আদালত।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, সরকার একটি নির্ভুল তদন্তের মাধ্যমে হলি আর্টিজান হামলার বিচারের পথ সুগম করেছে।
তিনি বলেন, “পুলিশ চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে এবং আদালত সেটি গ্রহণ করেছে। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে তদন্তে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করেনি। আশা করি দেশের ইতিহাসের এই জঘন্য হামলার বিচার হবে।”