হলি আর্টিজানে হামলা: সাত জঙ্গির ফাঁসি, দুজনের মাথায় আইএসের টুপি

প্রাপ্তি রহমান ও জেসমিন পাপড়ি
2019.11.27
ঢাকা
191127_Holy_Artisan_Verdict_1000.jpg রায় ঘোষণার পর হলি আর্টিজান হামলা মামলার আসামিদের আদালত থেকে বের করার সময় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাকিবুল ইসলাম ওরফে রিগ্যান মাথায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের (ইসলামিক স্টেট) পতাকার প্রতীক সংবলিত টুপি পরে ছিলেন। ২৭ নভেম্বর ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

আপডেট: ৭ নভেম্বর ২০১৯। ইস্টার্ন সময় দুপুর ১২.৩০

হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা মামলায় ফাঁসির রায় শুনে আদালতকক্ষ থেকে বের হওয়ার সময় দুই জঙ্গির মাথায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের (ইসলামিক স্টেট) পতাকার প্রতীক সংবলিত টুপি থাকার বিষয়টি নিয়ে নানা প্রশ্ন ও কৌতুহল সৃষ্টি করেছে।

বুধবার দুপুরে বহুল আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। রায়ে ৮ আসামির মধ্যে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে খালাস দিয়েছে আদালত।

রায় ঘোষণার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাত জঙ্গির মধ্যে অনুশোচনা দেখা যায়নি। ফাঁসির রায়ের পর আদালত কক্ষ থেকে আসামিদের বের করার সময় তাঁরা স্লোগান দেন। এ সময় আসামি রাকিবুল ইসলাম ওরফে রিগ্যান আইএসের টুপি মাথায় পরে ছিলেন। আদালত কক্ষ থেকে পাঁচতলা সিঁড়ি ধরে নামিয়ে প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় নিজেকে ‘আইএসের লোক’ বলে চিৎকার করছিলেন রিগ্যান।

আসামিদের প্রিজন ভ্যানে তোলার পর আরও এক জঙ্গিকেও কালো কাপড়ে তৈরি একই রকম টুপি পরতে দেখা যায়। ওই জঙ্গির নাম জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বুধবার এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিষয়টি তদন্ত করার কথা বলেন।

বাংলাদেশ সরকার আইএসের অস্তিত্ব অস্তিত্ব স্বীকার করে না। কিন্তু আদালতে পুলিশের জিম্মায় কীভাবে আইএসের প্রতীক সংবলিত টুপি এলো তা নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি তদন্তের জন্য অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন) কনের্ল আবার হোসেন, ডিআইজি ঢাকা টিপু সুলতান ও সহকারী কারা মহাপরিদর্শক আমিরুল ইসলামকে নিয়ে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে কারা অধিদপ্তরে। গঠিত কমিটিকে আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত প্রাঙ্গনে একজন আসামি টুপি পরেছিল যাতে লেখা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। তবে আইএসের কোনো টুপি নাই। আমার জানামতে আইএস টুপি তৈরি করেছে পৃথিবীর কোথাও এমন দৃষ্টান্ত নেই।”

“কাজেই এটি আসলে আইএসের পতাকার নির্দেশক হবে কিনা সেটি বিশ্লেষণের ব্যাপার। তথাপি এটি কোথা থেকে এলো আমরা তদন্ত করে দেখব,” বলেন মনিরুল ইসলাম।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, “কালো কাপড় ব্যবহার যেকোনো জঙ্গি সংগঠনের রেওয়াজ। আল কায়েদাও কালো কাপড়ে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লেখে।”

আলোচিত এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বেনারকে বলেন, “দণ্ডিত জঙ্গিরা আদালতে দাবি করেছে যে, তারা নির্দোষ। অথচ আজ তারা আদালতে তথাকথিত কালো টুপি পরেছিল। এটি প্রমাণ করে যে, তারা জঙ্গি এবং হলি আর্টিজান হামলায় জড়িত ছিল।”

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই জঙ্গিরা আইএসের সাথে সম্পৃক্ত না হলেও তাদের মতবাদে বিশ্বাসী।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা বেনারকে বলেন, “আইএসের নেটওয়ার্ক বাংলাদেশে নেই। তবে তাদের মতবাদে বিশ্বাসী দেশীয় জঙ্গিরা অবশ্যই আছে। যারা তাদের মতবাদে বিশ্বাস করে।”

 

 

দণ্ডিত যারা

দুই পুলিশ সদস্যসহ হলি আর্টিজান বেকারিতে নৃসংশভাবে ২২ জনকে হত্যার দায়ে সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্তরা হলেন, জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।

রায় ঘোষণার সময় এজলাসেই উপস্থিত ছিলেন তাঁরা।

অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলার আরেক আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দিয়েছে আদালত। রায় শুনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন মিজান।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পেয়ে বুঝতে পারব তাঁর বিষয়ে তদন্তে অথবা স্বাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপনে কোনো ঘাটতি ছিল কিনা।”

তবে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী সাংবাদিকদের বলেছেন, “খালাস পাওয়া আসামির ব্যাপারে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব।”

আইএসের অস্তিত্ব জানাতে হলি আর্টিজান হামলা

মধ্যপ্রাচ্য-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠির দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং জনমনে ভয় তৈরি করার উদ্দেশ্যে ওই হামলা চালানো হয়েছিল বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে আদালত।

পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, “হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।”

“কলঙ্কজনক এ হামলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র হরণের চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এর ফলে শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য পরিচিত বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুন্ন হয়। সেজন্য সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে আসামিরা কোনো ধরনের অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না,” বলা হয় পর্যবেক্ষণে।

এই রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে নাশকতার আশঙ্কায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়। বুধবার কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে জঙ্গি হামলা মামলার আসামিদের আদালতে আনা হয়। রায় ঘোষণার সময় আদালতে কয়েকজন বিদেশি নাগরিকও উপস্থিত ছিলেন।

আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারী কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু সাংবাদিকদের বলেন, “হলি আর্টিজানের মতো বর্বরোচিত হামলা যেন আর না ঘটে, এই রায় একটি দৃষ্টান্ত। আপাতত এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।”

পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর বিশ্লেষণ করে খালাস পাওয়া আসামি বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে হলি আর্টিজান হামলায় নিহতদের পরিবারও। ওই হামলায় নিহত ফারাজ আইয়াজ হোসেনের ভাই যারেফ আয়াত হোসেন বুধবার এক বিবৃতিতে সন্ত্রাসবাদের হুমকি মোকাবেলায় জিরো টলরেন্স নীতি গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

“আমাদের বিশ্বাস, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও এর মদদদাতাদের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াই বিরামহীনভাবে অব্যাহত থাকবে,” বিবৃতিতে বলেন যারেফ।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “এই রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে যাব।”

বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের রায়

জঙ্গিবাদ প্রশমনে এ রায়কে যুগান্তকারী উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, “এই ঘটনাটি আমাদের দেশের ভাবমূর্তি অনেকটা ম্লান করেছিল। এই রায়ে ফলে সেই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার হয়েছে।”

এ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বুধবার তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, “দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়, জঙ্গিবাদ নির্মূলে সরকার যে তৎপর, এ রায়ের মাধ্যমে সেটিও প্রমাণ হয়েছে।”

সাবেক আইজিপি নুরুল হুদাও এ রায়টাকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ দমনে জিরো টলারেন্স আছে, প্রতিরোধমুলক ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং ধর্মীয় উগ্রবাদকে বাড়ার সুযোগ বাংলাদেশ দেবে না এটা তারই পরিস্কার সিগন্যাল।”

“যে সকল কাজ করা হয়েছে এবং আসামিদের আইনের আতওায় আনা হচ্ছে সেটা স্পষ্ট হলো এ বিচারের মাধ্যমে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি ভালো আছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। কারণ, সর্বশেষ এক বছরে দেশে বড় ধরনের কোনো হামলা হয়নি।”

নজিরবিহীন সেই হামলা

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১ গুলশানের জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে ঢুকে পাঁচ জঙ্গি নৃশংসভাবে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জনকে হত্যা করে। এদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি, একজন ভারতীয় ও ৩ জন বাংলাদেশি। হামলা ঠেকাতে গিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন।

যৌথ বাহিনীর অভিযানে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। অভিযান চলাকালে ও পরে হাসপাতালে হলি আর্টিজান বেকারির দুই কর্মচারীও মারা যান। ওই হামলার মধ্য দিয়ে দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তারের এক বিপজ্জনক মাত্রা স্পষ্ট হয়েছিল।

২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই হামলা মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। গত এক বছরে রাষ্ট্রপক্ষ এই হামলা মামলায় ১১৩ জন সাক্ষী হাজির করে।

তদন্তের পরে পুলিশ জানায়, এই হামলায় জড়িত গোষ্ঠীর নাম নব্য জেএমবি। তারা ঘটনার পর নিজেদের আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস বলে দাবি করেছিল।

হলি আর্টিজান হামলার পরে সারা দেশে জঙ্গি দমন অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

গুলশান হামলার তদন্তে মোট ২১ জনকে চিহ্নিত করে পুলিশ। তবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এ হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী তামিম চৌধুরীসহ জড়িত গুরুত্বপূর্ণ আট জঙ্গি নিহত হওয়ায় জীবিত থাকা আট জনকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়। যাদের একজন খালাস পেয়েছেন আজ।

রায়ের আগে হলি আর্টিজান মামলার আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে খালাস দিয়েছে আদালত। ২৭ নভেম্বর ২০১৯।
রায়ের আগে হলি আর্টিজান মামলার আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে খালাস দিয়েছে আদালত। ২৭ নভেম্বর ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।