‘নিখোঁজ’ তরুণেরা নিখোঁজ নাকি সরকারি হেফাজতে, এমন সংশয় জোরদার হচ্ছে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.12.12
চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার পাঁচ তরুণই দাবি করেছে, র‌্যাবের গ্রেপ্তার অভিযানটি সাজানো ছিল। চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার এই পাঁচ তরুণই দাবি করেছে, র‌্যাবের গ্রেপ্তার অভিযানটি সাজানো ছিল। ডিসেম্বর ৮, ২০১৬।
স্টার মেইল

নিখোঁজ তরুণদের নিয়ে আবারো অস্বস্তি তৈরি হয়েছে জনমনে। গত দু’সপ্তাহের ব্যবধানে হঠাৎ আট তরুণ নিখোঁজ হয়েছেন। তবে তাঁদের সবাই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে নিখোঁজ হয়েছেন, না কি তাঁদের কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে আছেন সে নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে।

এই ধোঁয়াশা জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযানকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ। গতকাল সোমবার আদালতে জঙ্গি অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচ তরুণ দাবি করেন চট্টগ্রামে র‌্যাবের অভিযানটি ছিল সাজানো।

সম্প্রতি নিখোঁজ আট তরুণের মধ্যে চারজন বনানীর নর্দান ক্যাফের সামনে থেকে ১ ডিসেম্বর হঠাৎ উধাও হন। এর বাইরে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মাটিকাটা থেকে একজন, তেজগাঁও থেকে একজন সরকারী কর্মচারী এবং সবশেষ গত ৫ ডিসেম্বরর সদ্য ও লেভেল উত্তীর্ণ এক কিশোর কলাবাগান এলাকা থেকে নিখোঁজ হন।

পাবনা মেডিকেল কলেজ থেকে ২৯ নভেম্বর চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তানভীর আহম্মেদ তনয় ও ১ ডিসেম্বর একই বর্ষের ছাত্র ও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাকির হোসেন বিপ্লব নিখোঁজ হন। জাকির হোসেন বিপ্লব রংপুরের কাউনিয়া থেকে পাবনা মেডিকেল কলেজে আসার পথে নিখোঁজ হন। হঠাৎ উধাও ওই তরুণকে পরে ঢাকার শাহবাগ থেকে উদ্ধার করা হয়।

তবে এখনও নিখোঁজ আছেন জাকিরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তানভীর। তিনি বাড়ি থেকে রাগ করে ঢাকায় চলে আসেন বলে দাবি করেছে তার পরিবার।

বনানী থেকে একসঙ্গে নিখোঁজ হন চার তরুণ শাফায়াৎ হোসেন, জাইন হোসেন খান, মো সুজন ও মেহেদী হাসান। একমাত্র শাফায়াৎ হোসেনের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কিছু বিতর্কিত ব্যক্তির বক্তব্য দেখা গেছে।

মেহেদী হাসানের চাচা মাহবুব আলম বেনারকে বলেন, “মেহেদীর বাবা ঝালকাঠি সদর থানার কনস্টেবল। তিনি হার্ট অ্যাটাক করায় মেহেদী তাঁকে নিয়ে প্রথমে শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছিল, পরে ঢাকায় আসে। সে কখনও পরিবার বিচ্ছিন্ন ছিল না। তার উধাও হওয়ার বিষয়টি খুবই অদ্ভুত।”

বনানী থেকে নিখোঁজ সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ সাইদ আহমেদ খানের এক স্বজন কেউ নিখোঁজ হলেই জঙ্গিবাদে জড়ানোর অভিযোগ না তোলার অনুরোধ করেছেন। পাশাপাশি নিখোঁজ না অপহরণ তা-ও ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “বনানী থেকে চার তরুণের নিখোঁজ হওয়ার ধরন আলাদা। আমরা যে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছি তাতে ওই চার তরুণকে খুবই স্বাভাবিক অবস্থায় দেখেছি।”

“কারও মধ্যেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার কোনো লক্ষণ ছিল না। এর আগে ঘর ছাড়ার পর কাউকে কোথাও রাজধানীর ক্যাফেতে একত্রে বসে আড্ডা দিতেও দেখা যায়নি।”

এদিকে নিখোঁজ তরুণদের নিয়ে এমন আলাপ-আলোচনার মধ্যেই পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “জঙ্গি হামলা ঠেকানো ও নিখোঁজ তরুণদের খুঁজে বের করা এখন পুলিশের প্রধান কাজ। সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও অনেকে আছেন, যারা নিজে নিজে দীক্ষা নিয়ে ঘর ছাড়তে পারেন বা হামলা করতে পারেন।”

জঙ্গিবাদ দমনে পুলিশের বিশেষায়িত ওই ইউনিটটি বলছে, সব নিখোঁজ ব্যক্তিই জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছেন বিষয়টি তা নয়। তবে অনেকেই জড়াচ্ছেন। গুলশান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী মারজান ও বাশারুজ্জামানকে যতদিন পর্যন্ত না গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

ওই ইউনিটের কর্মকর্তারা আরও বলেন, গাজীপুরের পাতারটেকে অভিযান চালানোর অল্প কিছুদিন আগেও তাঁরা জানতেন সব জঙ্গি আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। অথচ ওই অভিযানে নয়জন নিহত হন। তাঁরা সবাই নিখোঁজ ছিলেন। কাজেই নিখোঁজ তরুণদের বিষয়টিকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।

গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার আগে ঘর ছাড়া তরুণদের ৬৮ জনের একটি তালিকা তৈরি করে র‌্যাব। ওই তালিকার সবাই এখনও বাড়ি ফেরেননি। সারা দেশের চিত্র মোটামুটি একই। কেউ ফিরেছেন কেউ ফেরেননি।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার ব্যক্তির স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন তাঁদের সন্তানদের আগেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, পরে অভিযানের নামে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। চট্টগ্রামে র‌্যাবের সর্বশেষ অভিযান নিয়ে এমন অভিযোগ উঠছে।

র‌্যাবের তালিকায় নিখোঁজ আছেন এবং পরিবারের পক্ষ থেকে প্রশাসনের লোক পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার জিডি থাকা স্বত্বেও পাঁচ তরুণকে চট্টগ্রামে অভিযানে গ্রেপ্তার হিসেবে দেখানো হয়েছে।

চট্টগ্রারে উত্তর কাট্টলীতে গত ৮ ডিসেম্বর র‌্যাব ৭ ওই অভিযান চালায়। ওই অভিযানে গ্রেপ্তার পাঁচ তরুণ ফরিদপুরের মাওলানা মো. তাজুল ইসলাম, যশোরের মো. নাজিমউদ্দিন, ঝিনাইদহের আবুজার গিফারী, নীলফামারীর নূরে আলম ইসলাম ও রংপুরের শেখ ইফতিশাম আহমেদ হরকাতুল জিহাদের সদস্য বলে দাবি করা হয়। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পরই অভিভাবকেরা দাবি করেন, সাদা পোশাকে তাঁদের আগেই তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

গতকাল ওই পাঁচ তরুণ আদালতে দাবি করেন, র‌্যাবের অভিযানটি সাজানো ছিল। র‌্যাবই উত্তরকাট্টলীর ওই বাসাটি ভাড়া করে এবং সেখানে তাদের রেখে যায়। কিছু অস্ত্রও রেখে যায় র‌্যাব।

সরকার পক্ষের কৌশুলী শাহাবুদ্দীন আহমেদ আদালতে দাবি করেন, অভিযুক্তরা নিজেদের বাঁচানোর জন্য এমন তথ্য দিচ্ছে।

তবে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম নাজমুল হোসেন চৌধুরী সাতদিন করে তিন দফায় রিমান্ডের আবেদন নাকচ করে দেন। তিনি একদিন করে মোট তিনদিন রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করেন ও সতর্কতার সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন।

এ বিষয়ে জানতে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁকে পাওয়া যায়নি।

‘নিখোঁজ’ তরুণেরা আসলে নিখোঁজ না সরকারি বাহিনির হেফাজতে এরকম সংশয় আসলে কী প্রভাব ফেলতে পারে, এমন প্রশ্নে সুপ্রীম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বেনারকে বলেন, ‘যে কোনও পরিস্থিতিতে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হয়, নইলে আইনের শাসন ভেঙে পড়ে। একসময় র‌্যাবের ক্রসফায়ারকে মানুষ স্বাগত জানিয়েছে, পরে র‍্যাবের বিরুদ্ধে ঘর থেকে তুলে এনে গুম করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।'

ওই আইনজীবীর মতে, “যে প্রক্রিয়ায় অভিযান হয়েছে বলে অভিযুক্তরা বলছেন, তা আইনের শাসনকে ব্যাহত করে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।