নিউইয়র্কে বোমা বিস্ফোরণ: আইসিসের পক্ষে হামলার কথা স্বীকার করেছে আকায়েদ

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.12.12
ঢাকা
সোমবার নিউইয়র্কে বোমা বিস্ফোরণ স্থলের কাছে নিরাপত্তারক্ষীদের টহল। সোমবার নিউইয়র্কে বোমা বিস্ফোরণ স্থলের কাছে নিরাপত্তারক্ষীদের টহল। ১২ ডিসেম্বর ২০১৭।
AP

বাংলাদেশি যুবক আকায়েদ উল্লা চরমপন্থী ইসলামি সংগঠন আইসিসের পক্ষে সোমবার নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারে হামলা চালানোর কথা স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

এদিকে আকায়েদ উল্লার স্ত্রী, শ্বশুর–শাশুড়ি এবং শ্যালকসহ কয়েকজন আত্মীয়–স্বজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। ঢাকায় এবং চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারের কাছে পোর্ট অথোরিটি বাস টার্মিনালের পাতালপথে সোমবার সকালে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হন ২৭ বছরের আকায়েদ উল্লাহ। এই বোমা হামলায় হামলাকারী আকায়েদ ও অন্য তিনজন আহত হন।

এ ঘটনায় গতকাল নিউইয়র্কের পুলিশ আকায়েদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলকভাবে অস্ত্র রাখা, সন্ত্রাসবাদী কাজ সমর্থন এবং সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি তৈরির অভিযোগ এনেছে।

নিজের বোমা বিস্ফোরণে আহত আকায়েদকে গ্রেপ্তারের পর চিকিৎসার জন্য স্থানীয় বেলেভু হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে সে হামলা সম্পর্কে তদন্তকারীদের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বলে নিউইয়র্ক সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে মঙ্গলবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জাননো হয়।

এতে বলা হয়, বোমা হামলা সম্পর্কে আকায়েদ তদন্তকারীদের জানায়, “আমি এটা ইসলামিক স্টেট এর জন্য করেছি।”

“সে (আকায়েদ) স্বীকার করেছে যে, আইসিস দ্বারা সে এই আক্রমণে উদ্বুদ্ধ হয়েছে, এছাড়া সে ২০১৪ সালের দিকে আইসিসের বিভিন্ন ধরনের প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিয়েছে বলেও স্বীকার করেছে,” মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন নিউইয়র্ক সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট এর ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল জুন কিম।

আকায়েদের আত্মীয়দের জিজ্ঞাসাবাদ

মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) আকায়েদের স্ত্রী, শ্যালক ও শ্বশুর–শাশুড়িকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সন্দ্বীপে গ্রামের বাড়িতেও পুলিশ তাঁর কয়েকজন নিকটাত্মীয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁর সম্পর্কে তথ্য জানার চেষ্টা করে।

গত বছরের জানুয়ারি মাসে আকায়েদ দেশে এসে বিয়ে করে। এ বছরের জুন মাসে ছেলে সন্তানের জনক হয় সে। তাঁর শ্বশুর বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের একটি দোকানে কাজ করেন। আকায়েদের স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে রাজধানীর জিগাতলার মনেশ্বর রোডের একটি বাসায় বাবা মায়ের সাথে থাকেন।

সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমরা আকায়েদের স্ত্রী ও শ্বশুর-শাশুড়িকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে এসেছি। তাদের কাছ থেকে আকায়েদ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।”

সিটিটিসির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, আকায়েদের স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়ি এবং শ্যালককে আটকের পর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কার্যালয়ে রাখা হয়েছে।

তারা বলেন, অপরাধী হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। তা ছাড়া বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার দেখালে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের আদালতে হাজির করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে ।

নিউইয়র্কে আক্রমণ সম্পর্কে জানতে পারার পর বাংলাদেশের পুলিশ আকায়েদের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এবং নিউইয়র্ক শহরের পুলিশ (এনওয়াইপিডি) বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তাদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে।

আকায়েদের চাচা আবদুল আহাদ বেনারকে জানান, “আকায়েদের বাবা-মা চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৫১ কিলোমিটার দূরের সন্দ্বীপ উপজেলার বাসিন্দা। হাজারিবাগ এলাকায় আকায়েদের জন্ম হওয়ার প্রায় ৩০ বছর আগে তার বাবা-মা ঢাকায় আসেন।”

আহাদ বলেন “আকায়েদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। সে সন্দ্বীপ থাকেনি। দুএকবার বেড়াতে গেছে।”

আহাদ নিজেও হাজারীবাগে থাকেন। তিনি বলেন, আকায়েদ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বিবিএ পড়া অবস্থায় সে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়।

আহাদের তথ্য অনুযায়ী, আকায়েদ স্ত্রী সন্তানকে দেখতে গত ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসে এবং ২২ অক্টোবর চলে যায়। এ সময় সে কারও সাথে দেখা করেনি। ঘরেই থাকত।

ঢাকার পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী ইন্সপেক্টর জেনারেল সোহেলি ফেরদউস বেনারকে জানান, পুলিশ এখন দেশি জঙ্গি বা অপরাধীদের সঙ্গে আকায়েদের সম্পর্কের কোনো প্রমাণ পায়নি।

তিনি আরও বলেন, “আমরা স্থানীয় জঙ্গি গ্রুপের সাথে তার কোনো সংযোগ আছে কি না তা যাচাই করতে আরও তদন্ত করব।”

২৭ বছর বয়সী আকায়েদ নিউইয়র্কের ট্যাক্সি চালাতেন। পরে তিনি একটি কোম্পানির মেকানিক হিসেবে কাজ করেন।

যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীবিরোধী মনোভাব চাঙা

একজন বাঙালি যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে এটা দেখে সাধারণ বাংলাদেশিরাও খুব কষ্ট পেয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সুমনা হক বেনার নিউজকে বলেন, “সে বাংলাদেশি নয়। সে চরমপন্থী সন্ত্রাসী। জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই, কোনো পরিচয় নেই, মানবতা নেই। সে বাংলাদেশের মানুষ, প্রবাসী এবং তাঁর স্বজনদের মারাত্মক ক্ষতি করেছে।

হামলার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেত নাগরিক গোষ্ঠীর মধ্যে অভিবাসীবিরোধী মনোভাব আরও চাঙা হয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মুখপাত্র সারাহ হাকাবি স্যান্ডার্স এই হামলার জন্য পারিবারিক ভিসা ব্যবস্থাকে দায়ী করে বলেন, “অভিবাসীদের যদি নিজেদের পরিবারের সদস্যদের এ দেশে নিয়ে আসার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে এমন ঘটনা ঠেকানো সম্ভব।”

এর আগে গত ২০১১ সালের ১৭ অক্টোবর বোমা হামলার ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে ফাঁদে ফেলে (স্টিং অপরাশেন) নিউইয়র্ক থেকে গ্রেপ্তার করা হয় কাজী রেজওয়ানুল আহসান নাফিসকে (২১)। নাফিসকে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত।

‘আমেরিকা ধ্বংস হবে’

এদিকে আকায়েদ গত এক বছর ধরে বোমা বানানোর কৌশল সম্পর্কে গবেষণা করছিল বলে আকায়েদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানান জুন কিম।

তিনি বলেন, “সে (আকায়েদ) হামলার জন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিকল্পনা করছিল। দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে থেকে বোমা তৈরির উপকরণ সংগ্রহ শুরু করে এবং আক্রমণের সপ্তাহখানেক আগে সে বোমাটি তৈরি করে।”

আকায়েদ নিজের বাড়িতেই বোমাটি বানিয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানায় অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস। এছাড়া ওই বোমা বিস্ফোরণে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে আকায়েদের আত্মঘাতী হওয়ার পরিকল্পনা ছিল বলেও জানান ভারপ্রাপ্ত অ্যাটর্নি জেনারেল জুন কিম।

ব্রুকলিনে আকায়েদের বাসা তল্লাশি করে পুলিশ বোমায় ব্যবহৃত উপকরণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন উপকরণ উদ্ধার করেছে বলেও জানান তিনি।

এছাড়া আকায়েদের পাসপোর্ট এবং তাঁর নিজের হাতে লেখা একটা নোটও তাঁর বাড়ি তল্লাশিকালে পুলিশ উদ্ধার করে বলে জানান তিনি।

এতে লেখা ছিল “নিজের কৃতকর্মেই আমেরিকা ধ্বংস হবে” (অল আমেরিকা, ডাই ইন ইওর রেজ), বলেন কিম।

এছাড়া অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বোমার হামলার দিন ভোরবেলা আকায়েদ তাঁর ফেসবুকে “ট্রাম্প তুমি তোমার জাতিকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছ,” বলে এক পোস্ট প্রকাশ করে।

আকায়েদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো প্রমাণিত হলে তাঁর যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে বলেও জানানো হয় অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের ওই বিজ্ঞপ্তিতে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।