নিউইয়র্কে বোমা হামলা: আকায়েদ দোষী হলে শাস্তি চান স্ত্রী

প্রাপ্তি রহমান
2017.12.20
ঢাকা
শিল্পীর তুলিতে নিউইয়র্কের বেলেভু হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় আকায়েদ উল্লার বিচারের ভিডিওচিত্রের স্কেচ। শিল্পীর তুলিতে নিউইয়র্কের বেলেভু হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় আকায়েদ উল্লার বিচারের ভিডিওচিত্রের স্কেচ। ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭।
রয়টার্স

নিউইয়র্কে বোমা হামলাকারী আকায়েদ উল্লাহর আচরণ কখনো অস্বাভাবিক মনে না হলেও দোষী হয়ে থাকলে শাস্তি দাবি করেছেন তাঁর স্ত্রী।

গত ১১ ডিসেম্বর নিউইয়র্কের ম্যানহাটন পোর্ট অথোরিটি বাস টার্মিনালে আকায়েদ উল্লাহ আত্মঘাতী বোমা হামলার চেষ্টা চালান। ওই ঘটনায় আকায়েদ উল্লাহসহ চারজন আহত হয়।

“আমি চাই বিষটি তদন্ত করা হোক। সে যদি দোষী হয় তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়া হোক,” বেনারকে বলেন আকায়েদের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জুই।

জুই দিন গুনছিলেন ছয় মাস বয়েসি ছেলেকে নিয়ে স্বামীর কাছে চলে যাওয়ার। গত সেপ্টেম্বরে ছেলেকে দেখতে এসেছিলেন আকায়েদ উল্লাহ।

এ প্রসঙ্গে জুই বেনারকে বলেন, “আমার স্বামী সেপ্টেম্বরে আসার পর অধিকাংশ সময়ই বাসায় থেকেছে। বাচ্চার সঙ্গে ছিল। সে নামাজ পড়ত ঠিক, কিন্তু আমার কখনো মনে হয়নি সে এরকম (জঙ্গিবাদী) কিছু করতে পারে।”

তিনি বলেন, “সে ফিরে যাওয়ার আগে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়েছিল সাহায্য দিতে। সে রোহিঙ্গাদের ওষুধ কিনে দিয়েছে। অন্য কোনো কারণে গিয়েছে বলে আমার মনে হয়নি।”

হাজার মাইল দূরে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানোর দায়ে এখন বিপদে পড়েছে আকায়েদ উল্লাহর স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা। আকায়েদের স্ত্রীর বাবা ও ভাই রাজধানীর একটি বিপণিবিতানের কর্মচারী।

বোমা হামলার একদিন পরই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) কার্যালয়ে আকায়েদ উল্লাহর স্ত্রী, শ্বশুর ও শাশুড়িকে ডেকে নেওয়া হয়।

সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানান, ঘটনাটি তদন্তে তাঁদের সঙ্গে ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) কাজ করছে। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা বেশ কিছু তথ্য পেয়েছেন।

আকায়েদের স্ত্রীকে উদ্ধৃত করে সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, প্রতিদিন বিকেলে তিনি ফোন করে স্বামীর ঘুম ভাঙাতেন। সেদিনও ভাঙিয়েছিলেন। তার কিছুক্ষণ পরেই ঘটে যায় এতসব ঘটনা। এখন ছ’মাসের ছেলে কোলে করে তাঁকে ছুটতে হচ্ছে।

আকায়েদ উল্লাহ এমন কিছু করবেন, আঁচ করতে পেরেছিলেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে জুই পুলিশকে বলেন, তাঁর স্বামী খুব স্বাভাবিক মাত্রায় ধর্মকর্ম করতেন। তাঁকেও ধর্মকর্ম করতে ও শালীন পোশাকে চলার উপদেশ দিতেন। স্বামী বোমা হামলা করে মানুষ খুন করতে পারেন, এমনটা কল্পনা করতে পারেন না তিনি।

তবে আকায়েদের শাশুড়ি মাহফুজা আখতার বেনারকে বলেন, “আমার জামাই এমন কাজ করতে পারে না। এটা একটি ষড়যন্ত্র। আমি চাই বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত হোক।”

স্বাভাবিক ও সাদাসিধে জীবনযাপন ছিল আকায়েদের

আকায়েদ উল্লাহ, তাঁর বাবা-মা, ভাই সবাই ঢাকার হাজারিবাগ এলাকার মনেশ্বর রোড ছেড়েছেন ২০১১ সালে। পিতার পরিচয়ে সবাই চিনতেন আকায়েদ উল্লাহকে। ওই পরিবারের এক তরুণ দুনিয়া কাঁপানো এমন কিছু ঘটাতে পারে, তা ওই এলাকার মানুষ চিন্তাও করতে পারছেন না।

গত মঙ্গলবার মনেশ্বর রোডে যাওয়ার পর আকায়েদ উল্লাহ সম্পর্কে জানতে কথা হয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে। আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের একজন ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব আবুল বশর।

“আকায়েদ উল্লাহ সানাউল্লাহ সাহেবের ছেলে। শৈশব থেকে তারে আমরা দেখছি। তারা বাবা সানাউল্লাহ বহু বছর ধরে ঢাকায় ছিল। স্বাধীনের (১৯৭১) পর থেকেই,” বেনারকে বলছিলেন আবুল বশর।

প্রবীণ ওই নাগরিক বললেন, “আকায়েদের বাবা ভালো লোক ছিল। বড় মাপের মুক্তিযোদ্ধা। তার ছেলে এইটা কীভাবে করল বুঝলাম না।”

এলাকার লোকজন জানালেন, আকায়েদ উল্লাহদের গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপে। তবে তাঁরা সবাই আকায়েদকে দেখেছেন একেবারে ছোটবেলা থেকে। আকায়েদের জন্ম এই হাজারিবাগেই। বেড়ে ওঠাও সেখানে।

কথা হচ্ছিল আবু ছায়েদ মিয়াজীর সঙ্গে। পেশায় ব্যবসায়ী। তাঁদের বাড়ি সন্দ্বীপে। আকায়েদের বাবা বয়সে তাঁর চেয়ে বেশ বড় ছিলেন, তবে পড়েছেন একই স্কুলে। তাঁদের ট্যানারির পাশেই মুদি দোকান চালাতেন সানাউল্লাহ।

“আমার চোখের সামনেই আকায়েদ বড় হয়েছে। শান্ত-শিষ্ট ভালো ছেলে। বড় ব্যাপার হলো ওর বাবা মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্মুখ সমরে ছিলেন। যুদ্ধে গোলাগুলির বিকট শব্দে তাঁর শ্রবণক্ষমতা কমে যায়,” আবু ছায়েদ মিয়াজী বেনারকে বলেন।

আবু ছায়েদ বলছিলেন, “আকায়েদের পরিবারের কেউ কখনো মৌলবাদী কোনো সংগঠনে যুক্ত ছিল না। আকায়েদের বাবা মনে প্রাণে সন্ত্রাসকে ঘৃণা করতেন। কিন্তু কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল বুঝতে পারছি না।”

“দেখুন হতাশ তরুণেরা এসব আত্মঘাতী হামলা চালায় বলে শুনি আমরা। ওর কীসের হতাশা? সন্দ্বীপে ওদের সম্ভ্রান্ত পরিবার। তালুকদার বাড়ি সবাই চেনে। ঢাকা শহরে মুদি দোকান করেছিলেন। বরাবর চেষ্টা করছেন আমেরিকা যাওয়ার। তাই এখানে বড় কোনো ব্যবসায় টাকা খাটাননি,” আবু ছায়েদ মিয়াজি বলেন।

আকায়েদ উল্লাহকে কেমন দেখেছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সে খুব স্বাভাবিক ও সাদাসিধে জীবনযাপন করত। কারও সঙ্গে কোনো বিরোধ দেখেননি।

কেমন ছিল আকায়েদের ছেলেবেলা। কাদের সঙ্গে মেলামেশা করত সে? কীভাবে উগ্রবাদের দীক্ষা নিল? এসব জানতে কথা হয় এলাকার আরেক বাসিন্দা আবদুল ওয়াহাবের সঙ্গে।

“ও আমার ছেলের বন্ধু ছিল। ছেলের নাম বলতে চাই না। ওরা একসঙ্গে জিগাতলার কাকলি স্কুলে পড়েছে। ওখান থেকে ২০০৪ সালে এসএসসি পাস করে। তারপর মুন্সী আবদুর রউফ রাইফেলস কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে। দুজনেই বিবিএতে ভর্তি হয়েছিল,” আবদুল ওয়াহাব বেনার নিউজকে বলেন।

আবদুল ওয়াহাব বলছিলেন, তাঁর বাড়িতেও বেশ কয়েকবার গেছে আকায়েদ। কখনো কোনো অস্বাভাবিকতা দেখেছেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাঁর কাছে আকায়েদের আচরণ কখনো সন্দেহজনক মনে হয়নি। তবে সে নামাজ পড়ত, দাঁড়ি রেখেছিল। এটুকুকে তিনি অস্বাভাবিকতা বলতে চান না।

তবে তাঁর কাছে আকায়েদকে বরাবরই তার অন্য বন্ধুবান্ধবদের তুলনায় একটু বেশি শান্ত মনে হতো। খেলাধুলা একরকম করতই না সে। বাড়ি থেকেও বের হতো খুব কম। বিবিএ পড়ার মাঝখানে ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ায় আকায়েদের সঙ্গে আর তাদের যোগাযোগ হয়নি। পরে শুনেছিলেন, আকায়েদ বিয়ে করেছেন দেশেই, তাঁর বোনের বান্ধবীকে।

‘স্বশিক্ষিত জঙ্গি’

আকায়েদের স্ত্রী জানান, তাঁকে তাঁর স্বামী সম্প্রতি জসীমউদ্দীন রাহমানীর বয়ান শুনতে বলেন। কিন্তু পুলিশ জান্নাতুলের বাসা থেকে জসীমউদ্দীন রাহমানীর লেখা কোনো বই পায়নি।

জসিমউদ্দীন রাহমানী নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা এবিটি) ও জামায়াতুল মুজাহিদীন, বাংলাদেশের অনুসারীদের তাত্ত্বিক গুরু। সে ব্লগার রাজীব হায়দার খুনের ঘটনায় বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।

আকায়েদের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন সম্পর্কে সিটিটিসি ও র‌্যাবের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর নেটওয়ার্ক ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে তারা সাংগঠনিক কাজে ব্যবহার করতে পারে এমন একটা আশঙ্কা আছে তাঁদের।

তবে সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম গত ১৩ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের বলেন, আকায়েদ উল্লাহ ২০১১ সালে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে আর দশটা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মতোই ছিল। জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কোনো অভিযোগই ছিল না তার বিরুদ্ধে।

“আমরা মনে করছি নিজে নিজেই ইন্টারনেট দেখে সে উগ্রবাদের দীক্ষা নিয়েছে। তার কাছে যে বিস্ফোরক পাওয়া গেছে সেটি তৈরি হয়েছে দেশলাইয়ের বারুদ থেকে। বাংলাদেশে থাকার সময়ে তার কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ আমরা পাইনি,” মনিরুল ইসলাম বলেন।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে কামরান রেজা চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।