কট্টরপন্থীদের আপত্তিতে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ কার্যক্রম স্থগিত

প্রাপ্তি রহমান
2019.12.30
ঢাকা
191230_story_milk_bank_1000.JPG ঢাকার কেরানীগঞ্জের এক হাসপাতালে নবজাতক কোলে একজন মা। ২৮ মে ২০১০।
[বেনারনিউজ]

আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা দেশের প্রথম ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ তাদের কার্যক্রম আপাতত স্থগিত করেছে। কট্টরপন্থীদের বাধার মুখে উদ্যোক্তা কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিলেও তাঁরা আইনী লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।

স্থগিত হয়ে যাওয়া মায়ের দুধ সংরক্ষণে প্রথম হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের উদ্যোক্তা ঢাকার মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইসিএমএইচ)। উদ্বোধনের বিষয়টি সংবাদপত্রে প্রচারের পরই কট্টরপন্থীরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।

হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের সমন্বয়ক আইসিএমএইচের সহযোগী অধ্যাপক মুজিবুর রহমান সোমবার বেনারনিউজকে বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান আইনী লড়াই করবে।

“মায়ের দুধ সংরক্ষণের জন্য আমাদের উদ্যোগটি বন্ধ হয়ে যায়নি, আপাতত স্থগিত রয়েছে, আশা করি আদালত আমাদের পক্ষে থাকবেন, আমরা আইনি লড়াই করব,” মুজিবুর রহমান বেনারনিউজকে বলেন।

তিনি বলেন, আদালতে রিটের জবাব পৌঁছালেই এ নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তা কেটে যাবে। আজ এ নিয়ে বৈঠকের কথা রয়েছে।

গত ২৪ ডিসেম্বর ইসলামী আন্দোলন ও তাফসির পরিষদের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহমুদুল হাসান ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও আইসিএমএইচ–কে আইনি নোটিশ দেন। তাঁদের দাবি হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক শরিয়াসম্মত নয়।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে হাসপাতালে বিপন্ন নবজাতকদের জীবনরক্ষায় এ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, যে মায়েদের সন্তান জন্মের পর মারা গেছে, বা নিজের সন্তানকে খাওয়ানোর পর যাঁদের বুকের দুধ উদ্বৃত্ত থাকছে তাঁরাই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকে দুধ দান করতে পারবেন।

আর এর গ্রহীতা হবে তারাই, যেসব নবজাতক জন্মের পরই মা হারিয়েছে, বিশেষ কারণে যেসব নবজাতক মায়ের কাছে থাকতে পারছে না, যেসব নবজাতক পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে বা যেসব নবজাতককে দত্তক নেওয়া হয়েছে এবং মায়ের দুধের অভাবে যাদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে।

বিতর্ক যে কারণে

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের অন্যতম মুখপাত্র আহমাদ আবদুল কাইয়ূম বলেন, শরীয়া আইন এ ধরনের হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক গঠনের অনুমতি দেয় না। এতে মুসলিম বিবাহপ্রথা হুমকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে।

“ইসলাম ধর্মে একজন মায়ের দুধ অন্য আরেকজন মায়ের সন্তান পান করতে পারবে, তবে এতে দুই মায়ের সন্তানেরাই ভাই-বোন হয়ে যাবে। ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে ইসলামে নিষিদ্ধ। হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক থেকে এ ধরনের নিষিদ্ধ ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে,” আহমাদ আবদুল কাইয়ুম বেনারনিউজকে বলেন।

আহমাদ আরও বলেন, তাঁরা কখনই এ ধরনের হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের পক্ষে নন।

তবে, সব ইসলামী চিন্তাবিদ বিষয়টির বিরোধিতা করছেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বলেন, হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক হতে পারে। তবে, যেহেতু ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা বেশি এবং ধর্মীয় বিধি-বিধান আছে, সেহেতু কর্তৃপক্ষের উচিত হবে কিছু বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া।

“হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকে সমস্যা নেই। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উচিত যে মায়ের দুধ সংরক্ষণ করা হবে, তাঁর নাম ও পরিচয় নিবন্ধন করে রাখা। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে বিষয়টিকে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য করতে এটা জরুরি। কর্তৃপক্ষ ধর্মবেত্তাদের সহযোগিতা নিতে পারেন,” হারুন অর রশিদ বলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গবেষণা মূল্যায়ন বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।

কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার বৃহত্তম ঈদ জামাতের ইমাম ও গ্র্যান্ড মুফতি ফরিদউদ্দীন মাসউদও এএফপিকে বলেছেন, “পাকিস্তান, ইরান, ইরাক ও মালয়েশিয়াসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোয় কীভাবে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক চলছে সে বিষয়ে আইসিএমএইচ খোঁজ খবর নিতে পারে।”

এদিকে আইসিএমএইচের মুজিবুর রহমান বলছেন, তিনি নিজে একজন মুসলিম। হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আগে বিশ্বের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোয় কীভাবে এটি পরিচালিত হয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়েছেন।

“প্রকল্পটি নিয়ে লুকোচাপার কিছু নেই। বিয়ে প্রথাটিকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দেওয়া হচ্ছে বলে যে অভিযোগ উঠছে তা ঠিক না। সে জন্য যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে,” মুজিবুর রহমান বলেন।

কী কী শর্ত অনুসরণ করা হয়েছে জানতে চাইলে মুজিবুর রহমান বলেন, প্রত্যেক মায়ের নাম নিবন্ধিত থাকবে। যে মায়ের মেয়ে সন্তান রয়েছে, তাঁর দুধ একটি মেয়ে শিশুকে আর যে মায়ের ছেলে সন্তান রয়েছে, তার দুধ ছেলেকে দেওয়া হবে। দুধ দানের ব্যাপারে মা ও তাঁর স্বামীর সম্মতি নেওয়া হবে। আইসিএমএইচ কী করতে চাচ্ছে সে সম্পর্কে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে অবহিত করা হয়েছে।

আইসিএমএইচ বলছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত মোট ২৫ জন মাতৃহীন, ৩৭ জন দত্তক শিশু ছিল। এদের বড় অংশই মারা যায়। বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব হলে এই শিশুরা বেঁচে যেত।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।