হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাফাই পুলিশের পক্ষে
2016.11.03
ঢাকা থেকে
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও প্রশাসনের গাফিলতি ছিল মর্মে অভিযোগ করে আসছেন মানবাধিকার কর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা। এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাফ বলে দিলেন, ওই ঘটনায় পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল না।
ঘটনার পর জেলা পুলিশ, পুলিশ সদর দপ্তর ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোট তিনটি কমিটি গঠিত হয়েছে। এসব কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার আগেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া এই বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
“তদন্ত শেষ হওয়ার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এভাবে আগাম মন্তব্য করতে পারেন না। তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে আবার প্রমাণ হল যে, বিচার বিভাগীয় তদন্ত ছাড়া এই ঘটনার বিচার হবে না,” জানান বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওই নেতা জানান, সরকারের অবস্থান হচ্ছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য পুলিশকে দায়িত্বহীন আচরণ করতে উৎসাহ জোগাতে পারে। এতে সন্ত্রাসীরাও উৎসাহিত হতে পারে।
উল্লেখ্য, গত রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে দল বেঁধে ১৫টি মন্দির এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক ঘর ভাঙচুর করা হয়। ২৮ অক্টোবর নাসিরনগরে জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ফেইস বুক পাতায় একটি পোস্ট নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত ।
ফেইস বুকে রসরাজ ‘ইসলাম অবমাননা করে’ পোস্ট দিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠার পর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।
এই হামলার পর প্রত্যাহার করা হয়েছে নাসিরনগর থানার ওসি আবদুল কাদেরকে। দায়ের করা হয় দুটি মামলা, যার প্রত্যেকটিতে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা ১০০০ থেকে ১২০০ জনকে।
পুলিশের গাফিলতি ছিল না: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, “আমাদের কোনো গ্যাপ ছিল কি না, দেখা হচ্ছে। তবে আমরা মনে করি, পুলিশ বাহিনী বা ওই কর্মকর্তার (ওসি) কোনো গ্যাপ ছিল না। তারা আরও তৎপর থাকতে পারত। এ জন্যই ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।”
মন্ত্রী বলেন, ওই ঘটনা তাঁরা ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। যে কারণে এ ঘটনা ঘটেছিল, সে বিষয়েও তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীও তাৎক্ষণিকভাবে টিম পাঠিয়েছেন। দলীয়ভাবেও টিম গিয়েছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ থেকে টিম গিয়েছে। কী ঘটনা ঘটেছে তা সবাই জানে।
তবে ভিডিওচিত্র ও আলোকচিত্রে দেখা যায়, মন্দিরে হামলার সময় তিনজন পুলিশ হামলাকারীদের সঙ্গে ছিল। এঁদের দুজনের হাতে ছিল লাঠি, আরেকজনের হাতে অস্ত্র। হামলাকারীদের সঙ্গে হাঁটতে দেখা গেলেও হামলা ঠেকাতে তাঁদের তৎপরতা দেখা যায়নি।
দূরদর্শিতার অভাব ছিল: মানবাধিকার কমিশন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশের ভূমিকায় সন্তুষ্ট থাকলেও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, প্রশাসন ও পুলিশের দূরদর্শিতার অভাব হামলার সুযোগ করে দিয়েছে। কমিশন অদূরদর্শিতার বিষয়ে তদন্ত করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে বলেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ছিল সুপরিকল্পিত।
হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন আয়োজিত মানববন্ধনে হিন্দু নারীরা অংশ নেন। নভেম্বর ০৩, ২০১৬।
বৃহস্পতিবার রাজধানীতে মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনার দিন সমাবেশের অনুমতি দিলেও প্রশাসন পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না রাখায় এ হামলা ত্বরান্বিত হয়েছে।
ঘটনার পর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ভুক্তভোগী, প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এ প্রতিবেদন তৈরি করেন। কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান।
প্রশাসনের গাফিলতি দায়ী: আহলে সুন্নাত
হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় নিজেদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত। সংগঠনটি ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে ।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির নেতারা দাবি করেছেন, সেদিন প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই সেদিন শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছিলেন তারা।
রসরাজ নামে ওই হিন্দু যুবককে কারাগারে পাঠানোর পর ওই সমাবেশ ডেকেছিল আহলে সুন্নাত। সংগঠনের সমন্বয় কমিটির সদস্যসচিব মোছাহেব উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনার জন্য প্রশাসনের গাফিলতিকে দায়ী করেন।
আরও একজন গ্রেপ্তার
নাসিরনগর উপজেলায় মন্দির ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় আরও একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ । এ নিয়ে এ ঘটনায় মোট ১০ জন গ্রেপ্তার হলেন।
উপজেলার চাপরতলা পশ্চিমপাড়া গ্রামের মহিউদ্দিন আহমেদ বেলালকে (৩০) বৃহস্পতিবার ভোরে গ্রেপ্তার করা হয় বলে বেনারকে জানান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন ।
ইকবাল হোসাইন বলেন, “ভাঙচুর ও লুটপাটের সময় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ দেখে মহিউদ্দিনকে শনাক্ত করা হয়। পরে পুলিশ বেলালকে তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে।”
ফেসবুকে উসকানিমূলক পোস্ট নয়: পুলিশ
ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মীয় উসকানিমূলক পোস্ট না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ । বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ আহ্বান জানানো হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ফেসবুক পোস্ট নিয়ে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা ও মন্দির ভাঙচুরের পরে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ আহ্বান এসেছে। ওই হামলার সময় পুলিশ সদস্যদের নির্লিপ্ততার অভিযোগও করছেন ঘটনার শিকার অনেকেই।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একটি স্বার্থান্বেষী মহল ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক পোস্ট ও আপত্তিকর ছবি এবং মন্তব্য পোস্ট করে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করছে। এ ধরনের কাজ করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
কোনো ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত না হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য পুলিশ সদর দপ্তর সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।
তিন জেলায় প্রতিমা ভাঙচুর
যশোর শহর, বগুড়ার ধুনট ও ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে তিনটি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে । যশোরে দুই হামলাকারীকে স্থানীয় লোকজন ধরে পিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন।
গত বুধবার রাত ১০টার দিকে শহরের ধর্মতলা এলাকার সর্বজনীন কালীমন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় লোকজন শামীম ও জসিম নামে দুজনকে ধরে পিটুনি দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে।
জেলার ধুনটে দুর্বৃত্তরা চারটি প্রতিমা ভাঙচুর করেছে। উপজেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আশিস কুমার বেনারকে জানান, বুধবার দিবাগত রাতে দুর্বৃত্তরা প্রতিমার মাথা ভাঙচুর করে শ্মশান ঘাটের পাশে ফেলে রাখে।
ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে একটি পারিবারিক মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গত বুধবার দিবাগত গভীর রাতে উপজেলার রূপাপাত ইউনিয়নের রূপাপাত গ্রামের আনন্দ বিশ্বাসের বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে।
“এসব হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার সারা দেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে মানববন্ধন কর্মসূচি ডাকা হয়েছে,” বেনারকে জানান রানা দাশ গুপ্ত।