আহমদীয়া কন্যা শিশুর লাশ কবর থেকে তুলে ফেলার ঘটনায় মামলা হয়নি

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.07.13
ঢাকা
200713_Ahmediya_1000.jpg ঢাকার বকশিবাজারে আহমদীয়া মুসলিম জামাতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও মসজিদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন কয়েকজন পথচারী। ১৩ জুলাই ২০২০।
[কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ]

সংখ্যালঘু আহমদীয়া মুসলিম পরিবারের দুইদিন বয়সী এক কন্যা শিশুর লাশ সম্প্রতি কবর থেকে তুলে বাইরে ফেলে দেয়ার ঘটনা তদন্ত শুরু করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ।

তবে এ ব্যাপারে এখনো কোনো মামলা হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান।

নিহত মেয়েটির পিতা সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, তাঁরা এই অপরাধের জন্য কোনো মামলা করবেন না। তাঁর ভাষায়, তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছ থেকে কোনো বিচার পাবেন না।

মানবাধিকার কর্মীদের মতে, আহমদীয়ারা মামলা করলে তাঁদের ভিটেমাটি ছাড়া করবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। কারণ জেলার পুলিশ, প্রশাসনও অনেক সময় স্থানীয় উগ্র ধর্মীয় নেতাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে।

ঘটনা জানাজানি হলে দেশীয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন দোষীদের শাস্তি দাবি করে এই ঘটনার নিন্দা জানায়। এরপর তৎপর হয় পুলিশ প্রশাসন। তবে কাউকে এখনও পর্যন্ত গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।

কী ঘটেছিল?

নেত্রকোনা জেলার অধিবাসী এবং ফেনী সদর থানার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম ও মোছাম্মত স্বপ্না আক্তার দম্পতির দ্বিতীয় কন্যার জন্ম হয় গত ৭ জুলাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি হাসপাতালে মেয়েটির জন্ম হয়। নির্ধারিত তারিখের এক মাস আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া মেয়েটি ৯ জুলাই মারা যায়। একইদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ঘাটুরা সরকারি কবরস্থানে দাফন করা হয় মেয়েটিকে।

মেয়েটির পিতা সাইফুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমরা যখন মেয়েটিকে কবর দিতে যাচ্ছিলাম তখন কয়েকজন মানুষ আমাদের শুনিয়ে বলছিল, ‘লাশ তুলে ফেলে দেবো। আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি। আমরা কবর দিয়ে চলে যাওয়ার পর পুলিশ আমাদের ডেকে পাঠায়। পরে আমরা গিয়ে দেখি আমার মেয়ের লাশ একটি চাটাই দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় কবরস্থানের পাশে রাখা আছে।”

তিনি বলেন, “এর আগে ঘাটুরা গ্রামের দুটি মসজিদ থেকে ‘কাদিয়ানির’ লাশ গোরস্তানে দাফন ঠেকাতে বলা হয়। এরপর ২০/২৫ জন উগ্রবাদী এই ঘটনা ঘটিয়েছে।”

সাইফুল ইসলাম বলেন, “পরে পুলিশ এসে আমাদের জানায়, আমরা যেন আহমদীয়া সম্প্রদায়ের কবরস্থানে আমার মেয়েকে কবর দিই। পুলিশের কথা মতো আমরা কোনোরকম সংঘাতে না জড়িয়ে কয়েক মাইল দূরে আহমদীয়া সম্প্রদায়ের কবরস্থানে তাকে দাফন করি।”

মামলা করবেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সাইফুল ইসলাম বলেন, “আমরা মামলা করব না। কারণ মামলা করলে বিচার পাব না। লাশ তুলে ফেলা চরম অপরাধের একটি। এই অপরাধের জন্য দায়ীদের সাজা দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমি মনে করি পুলিশ মামলা করতে পারত।”

তবে এই ঘটনায় পুলিশও কোনো মামলা দায়ের করেনি বলে জানান পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান।

তিনি বেনারকে বলেন, “তবে আমরা একজন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ঘটনা তদন্ত করতে দায়িত্ব দিয়েছি। তদন্ত শেষ হলে আপনারা জানতে পারবেন।”

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বেনারক বলেন, “মতাদর্শগত তফাতের কারণে কবর থেকে লাশ তুলে ফেলে দেয়ার ঘটনা বাংলাদেশে আগে কখনও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। এর মতো জঘন্য ঘটনা আর হতে পারে না।”

তাঁর মতে, “বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া উচিত, যদিও আমরা জানি না আদৌ কেউ গ্রেপ্তার হবে কি না।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে আহমদীয়ারা সংখ্যায় খুব নগণ্য। কিন্তু তারপরও তাঁদের প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখায় ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিচালনা করেন কিছু ধর্মীয় নেতা, যারা আহমদীয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছেন।”

অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, “ভুক্তভোগীরা যদি পুলিশের কাছে মামলা করে, তাহলে তারা আরও বিপদে পড়বে। তখন ওই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বলবে, ‘তোরা অমুসলিম। তোরা আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস কোথায় পেলি?’ তখন তাদের এলাকা ছাড়া করবে।”

তিনি বলেন, মামলা ছাড়া তদন্ত করে কী হবে সেটি বোঝা শক্ত।

মানবাধিকার সংগঠন আর্টিক্যাল-১৯ এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে দেয়া এক বিবৃতিতে জানায়, “গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের আহমদীয়া সম্প্রদায়ের মানুষ আক্রমণ এবং সামাজিক নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। বিশ্বাস ও পরিচয়ের কারণে তাঁদের মসজিদ, বাসাবাড়ি আক্রান্ত হচ্ছে যদিও বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করতে পারবে না।”

সংগঠনটি জানায়, এ ধরনের ঘটনার বিচার না হলে জবাবদিহিতা থাকে না এবং বিচারহীনতার কারণে তা একটি সম্মিলিত সমাজ গঠনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

এদিকে এক বিবৃতিতে এই ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশে আহমদীয়া মুসলিম জামাত।

বাংলাদেশে প্রায় এক লাখের মতো কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন। কাদিয়ানিরা নিজেদের আহমদীয়া মুসলিম জামা'তের সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন। তবে সুন্নি এবং শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানেরা তাঁদেরকে মুসলমান হিসেবে স্বীকার করেন না। ফলে এ দেশে তাঁরা মুসলিম সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচিত।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।