গুম হবার ১৫ মাস পর ফিরলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত

প্রাপ্তি রহমান
2019.03.18
ঢাকা
190318_Maroof_Zaman_620.jpg সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান।
[সৌজন্যে: মারুফ জামানের পরিবার]

নিখোঁজ হবার ৪৬৭ দিন পর সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান বাড়ি ফিরলেও পুলিশ বা পরিবারের সদস্যদের কেউই এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। এতোদিন কোথায় ছিলেন, তা নিয়ে মারুফ নিজেও গণমাধ্যমের সামনে কিছু বলতে চান না। আর পুলিশ বলছে পারিবারের কাছ থেকে তারাও কোনো তথ্য পাচ্ছে না।

মারুফ জামান ফিরে আসার পর পুলিশ কোনোকিছু জানতে পেরেছে কিনা—এই প্রশ্নের জবাবে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল লতিফ বেনারকে বলেন, “মারুফ ফিরে এসেছেন, এটা নিশ্চিত হয়ে আমরা তাঁর বাসায় ফোর্স পাঠাই। তাঁর মেয়ে সামিহা জামান জানান, বাবা ফিরে এসেছেন। তবে তিনি কথা বলবেন না।”

সামিহা জামান বলেছেন, শুক্রবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে তিনি ফিরেছেন, জানান ওসি।

ওসি আরও জানান, সামিহা বলেছেন তাঁর বাবা বাসা চিনতে পারছিলেন না। বাসার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক চিনতে পেরে তাঁকে ভেতরে নিয়ে আসেন।

এদিকে শনিবার সন্ধ্যায় এক ফেসবুক পোস্টে মারুফ জামানের বড় মেয়ে শবনম জামান খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, “এই মুহূর্তে তাঁরা বিস্তারিত কিছু বলতে চাইছেন না।”

শবনম জামান লেখেন, “সাড়ে ১৫ মাস পর বা ৪৬৭ দিন পর বাবা বাড়ি ফিরেছে। আমার বোন ও আমি এই দিনগুলোয় যাঁরা সমর্থন যুগিয়েছেন তাঁদের প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।”

শবনম আরও বলেন, যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাঁরা গেছেন সেটা ভুলে থাকতে কিছুটা সময় প্রয়োজন। এই মুহূর্তে এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য বা বিস্তারিত কিছু তাঁরা প্রকাশ করতে চাইছেন না।

মারুফ জামান ফিরে আসায় নিখোঁজ আছেন এমন ব্যক্তির স্বজনেরা নতুন করে প্রিয়জনদের ফিরে পাওয়ার আশা করছেন। তবে শেষ পর্যন্ত কতজন ফিরে আসবেন তা নিয়ে সংশয়ও আছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, “লম্বা সময় পর মারুফের ফিরে আসায় অনেকের মনে সেই আশা জেগেছে। কিন্তু রাষ্ট্রের আচরণে এখনও পর্যন্ত ঘটনার শিকার মানুষগুলোর প্রতি অনুকূল নয়। নতুন করে গুম শুরু হয়েছে। ফলে মানুষ ভাবতে পারছে না সে নিরাপদ।”

২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ছোট মেয়ে সামিহা জামানকে নিতে নিজেই গাড়ি চালিয়ে ধানমন্ডি থেকে রওনা দিয়েছিলেন। ওই রাতেই পৌনে ৮টার দিকে ফোন করে গৃহকর্মীকে বলেন, কয়েকজন লোক বাসায় যাবে। তারা কিছু নিয়ে যাবে। এরপরই সুঠামদেহী তিন ব্যক্তি নাক পর্যন্ত টুপিতে ঢেকে বাসায় ঢোকেন ও বাসা থেকে মুঠোফোন, ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের সিপিইইউ নিয়ে চলে যান।

ওই ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় পরিবারের পক্ষ থেকে একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। খোঁজা হচ্ছে—এর বাইরে আর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি থানা থেকে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ পুরনো। দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর অনেককেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর নজির আছে, কারও কারও মৃতদেহও পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা রেজওয়ান হারুনের উদাহরণ টেনেছেন। তিনি হারুন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক হারুন অর রশিদের ছেলে। ২০১৭ সালের ১২ মে সন্দেহভাজন জঙ্গি রেজওয়ান হারুন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে নামার পরপরই নিখোঁজ হন। চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায়। এতদিন তিনি কোথায় ছিলেন সে সম্পর্কে কিছু বলেনি কর্তৃপক্ষ।

তবে পুলিশ ও র‍্যাব অভিযোগ অস্বীকার করছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, তাঁরা গ্রেপ্তারের ২৪ ঘন্টা পর নিয়ম অনুযায়ী আদালতে উপস্থাপন করে থাকেন। অন্যদিকে র‍্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান বলছেন, নিখোঁজ হওয়ার পর তাঁরা সাহায্যপ্রার্থীদের সহযোগিতার চেষ্টা করেন।

নতুন করে নিখোঁজ তিন, ফেরেননি অনেকে

টানা তৃতীয় দফা সরকার গঠনের দু’মাসের মাথায় নতুন করে শুরু হয় গুম। এ পর্যন্ত দুজনকে প্রশাসনের লোক পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে, তাছাড়া রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ আছেন একজন।

রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ একজন সাবেক সেনাসদস্য কর্পোরাল মুকুল হোসেন। তাঁর স্ত্রী জেসমিন আরা বেনারকে জানান, গত ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি কলাবাগানে বন্ধুর বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। সেখান থেকে ডিবি পরিচয়ে একদল লোক তাকে তুলে নিয়ে যায়।

“আমি কলাবাগান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছি। ডিবিতে গিয়েছি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আবেদন জানিয়েছি। তারপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খোঁজার কোনো উদ্যোগ নেয়নি,” জেসমিন আরা বলেন।

এই ঘটনার ২৪ দিন পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ হন মো. শরিফ আলী। তাঁর স্ত্রী সাদিয়া আলী বলেন, কিছুক্ষণ পর বাড়ি ফিরবেন জানিয়ে শরিফ সে রাতে লালবাগের বাসা থেকে আজিমপুরে যান। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বন্ধু রাব্বী। রাত সাড়ে ১০টার দিকে দু/তিনজন যুবক তাঁকে স্যার সলিমুল্লাহ মাদরাসার ভেতরে নিয়ে যান। এরপর থেকে কোনো খোঁজ নেই। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মাদরাসার নিরাপত্তারক্ষী মিলন ও জিয়াউল। কথা হচ্ছিল জিয়াউলের সঙ্গে।

“রাতে বিদ্যুৎ ছিল না। বৃষ্টিও হচ্ছিল ঝিরঝির করে। মূল ফটকে তালা দিয়ে আমি শুয়ে পড়েছিলাম। এ সময় কয়েকজন লোক এসে ফটক খুলে দিতে বলে। ওরা প্রশাসনের লোক বলে পরিচয় দেয়,” জিয়াউল বেনারনিউজকে বলেন।

মো. শরিফ নিখোঁজের ঘটনায় সাদিয়া আলী লালবাগ থানায় জিডি করেছেন। লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবাস চন্দ্র পাল তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বেনারকে বলেন, “আমরা শরিফের নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়েছি। তাঁকে খোঁজা হচ্ছে।”

নিখোঁজ আছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুহুল আমিন। ১ মার্চ রাত ৯টার দিকে কাফরুলের বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই বলে জানিয়েছেন রুহুল আমিনের ভাই রাইসুল ইসলাম।

রাইসুল জানান, তিনি রুহুল আমিন নিখোঁজের ঘটনায় কাফরুল থানা ও র‍্যাব–৪ এ অভিযোগ জানিয়েছেন।

মানবাধিকার সংস্থা অধিকার গতবছর আগস্টে গুম দিবসের প্রাক্কালে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজদের তালিকা চূড়ান্ত করে। সে হিসেবে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৪৩৫ জন রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন, মৃতদেহ পাওয়া যায় ৫৫ জনের, জীবিত ফিরেছের ২৪৪ এবং বাকি ১৩৬ জন কোথায় আছেন সে সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি কিছু।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।