আড়াই মাস পর খোঁজ মিলল সাংবাদিক উৎপল দাসের

পুলক ঘটক
2017.12.20
ঢাকা
ফিরে আসার পর মায়ের সাথে সাংবাদিক উৎপল দাস। ফিরে আসার পর মায়ের সাথে সাংবাদিক উৎপল দাস। ২০ ডিসেম্বর ২০১৭।
বেনারনিউজ

দুই মাস ১০ দিন নিখোঁজ থাকার পর খোঁজ মিলেছে সাংবাদিক উৎপল দাসের। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১ টার দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার আধুরিয়া শাহজালাল সিএনজি ফিলিং স্টেশনের কাছে একটি মাইক্রোবাস থেকে তাকে নামিয়ে দেওয়া হয়।

গত ১০ অক্টোবর দুপুরে মতিঝিলে তার কর্মস্থল পূর্ব পশ্চিম বিডি ডট নিউজের কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পর থেকে খোঁজ মিলছিল না উৎপলের। সাংবাদিকদের টানা আন্দোলনের মাঝে নিখোঁজের সন্ধান মিললেও অপহরণের পুরো ঘটনা এখনো রহস্যাবৃত রয়ে গেছে।

অজ্ঞাত ব্যক্তিরা রাজধানীর ঢাকার ধানমন্ডি এলাকা থেকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়ে একটি জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় টিনশেড ঘরে আটকে রেখেছিল বলে বেনারকে জানিয়েছেন উৎপল দাস। অপহরণকারীরা তাঁর কাছে টাকা দাবি করেছিল বলেও তিনি জানান।

তবে নিখোঁজ হয়ে ফিরে আসা অন্যান্যদের মতোই কারা তাকে ধরে নিয়েছিল, কোন এলাকায় আটকে রেখেছিল তার কোনো তথ্য দিতে পারেননি উৎপল।

যেভাবে পাওয়া গেলো

মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ করেই সচল হয়ে ওঠে উৎপলের মোবাইল ফোন। তাঁর ভাইবার অ্যাকাউন্ট সক্রিয় দেখা যায়। তখন থেকেই বেনারের পক্ষ থেকে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু নম্বরটি ব্যস্ত পাওয়া যাচ্ছিল।

এই সময়ের মধ্যে তার সহকর্মী ও বন্ধুদের অনেকে উৎপলকে পাওয়া গেছে বলে ফেসবুকে পোস্ট দিতে শুরু করেন। রাত ১২টায় বেনার প্রতিবেদকের সঙ্গে উৎপলের কথা হয়। তিনি বলেন, “কিছু লোক একটি মাইক্রোবাসে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। আমি এখন ভালো আছি। সকালে ঢাকায় আসব।”

তখন তাঁর অবস্থান রূপপুরের আধুরিয়া এলাকার একটা ফিলিং স্টেশন জানিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আর বেশি কিছু বলতে চাননি উৎপল।

উৎপলকে উদ্ধার করার দাবিতে চলমান সাংবাদিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ বেনারকে বলেন, “খবর পেয়ে রাত একটার দিকে আমরা রূপপুর ছুটে যাই। আমরা পৌঁছার আগেই পুলিশ তাকে ভূলতা ফাঁড়িতে নিয়ে যায়।”

“সেখানে পৌঁছামাত্র ভূলতা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শহীদুল ইসলামের কক্ষে বসে থাকা উৎপল আমাদের জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। সে বারবার বলছিল, ভাই আমি বেঁচে আছি। এ সময় উৎপল সুস্থ থাকলেও তাকে রীতিমতো বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল,” জানান রাজু আহমেদ।

পরে রাত আড়াইটার দিকে তাঁকে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরায় নিয়ে যাওয়া হয়।

বিস্তারিত জানতে চাইলে বুধবার উৎপল বেনারকে বলেন, “মঙ্গলবার রাতে আমাকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে উঠায়। তিন-চার ঘণ্টা পর আমাকে ফিলিং স্টেশনের কাছে নামিয়ে দেয়। নামানোর সময় আমার চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে তারা বলেছে, পেছনের দিকে তাকাবি না। তাকালেই গুলি করব। সামনে ফিলিং স্টেশন। সেখানে চলে যা।”

অপহরণের ঘটনা বর্ণনা করে উৎপল বলেন, “১০ তারিখ ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে টেলিফোনে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলাম। সেসময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি মাইক্রোবাস থেকে চার পাঁচজন লোক নেমে আমাকে তুলে নিয়ে আমার চোখ বেঁধে ফেলে।”

তিনি জানান, “আনুমানিক চার ঘণ্টা আমাকে নিয়ে মাইক্রোবাসটি চলেছিল। এরপর জঙ্গলের মধ্যে একটি ছোট টিনশেড ঘরে আমাকে আটকে রেখেছিল। ঘরে কোনো খাট ছিল না, একটা তোশক ছিল। সেখানে ফ্লোরে ঘুমাতাম। তিন বেলা দরজার নিচ থেকে একটা ফোকর দিয়ে আমাকে খাবার দিত।”

“অপহরণকারীরা খুব বেশি নির্যাতন চালায়নি। তুলে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথম দিকে চড় থাপ্পড় মারত। কোনো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করত না। বলত, তোর অনেক টাকা। আমাদের টাকা দে,” বলেন উৎপল।

তিনি বলেন, “টাকা না দিলে মেরে ফেলবে বলেছিল। মুখোশ পরা লোকগুলোর চোখ ছাড়া কিছু দেখা যেত না। অপহরণের সময়ই তারা আমার মোবাইল ফোন এবং পকেটে থাকা ৩০০ টাকা কেড়ে নিলেও ছেড়ে দেওয়ার সময় সেসব ফেরত দেয়।”

অপহরণকারীদের সম্পর্কে উৎপল কোনো তথ্য দিয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হলে রূপগঞ্জ থানার ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক শহীদুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “তাকে কে নিয়ে গেছে, কারা নামিয়ে দিয়ে গেছে কিছুই তিনি বলতে পারেননি।”

প্রতিকার চান না ভুক্তভোগীরা

এই অপহরণের জন্য, কিংবা তাকে উদ্ধারে ব্যর্থতার জন্য কারও প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই সাংবাদিক উৎপল দাসের। বিচার বা প্রতিকারও তিনি চান না।

বেনারকে উৎপল বলেন, “আমি একটা নতুন জীবন পেয়েছি। সাংবাদিক নেতা, সহকর্মীসহ সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকব। বাইরে আওয়াজটা ছিল বলেই বোধ হয় বেঁচে গেছি।”

“সবাই চেষ্টা করেছে। আমি কাউকে দোষারোপ করব না। মামলা মোকদ্দমা চাই না। পেছনেও তাকাতে চাই না,” তিনি বলেন।

উৎপলের বাবা চিত্তরঞ্জন দাস বেনারকে বলেন, “ছেলেকে আমি ফিরে পেয়েছি এটাই আমার বড় আনন্দ। আমরা কোনো মামলা করব না।”

উৎপল নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে পরিবারের পক্ষ থেকে ২৩ অক্টোবর থানায় জিডি করা হয়েছিল। তার সন্ধান চেয়ে রাজপথে প্রায় প্রতিদিনই নানা কর্মসূচি পালন করেছে সাংবাদিকরা।

পেছনের দিকে তাকাতে চান না উৎপলের কর্মস্থল পূর্বপশ্চিমবিডি ডট নিউজে’র সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমানও।

“উৎপলকে ফিরে পাওয়ায় আমার বুক থেকে একটা ভারী পাহাড় নেমে গেছে। এর চেয়ে বেশি সুখ নেই। আমি আর কোনো কিছু খোঁজাখুঁজি করতে চাই না,” বেনারকে বলেন পীর হাবিব।

কারা এই মুখোশধারী?

গত চার মাসে ১৫ জন নিখোঁজ হন। এদের মধ্যে উৎপল, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়সহ চারজন ফিরে এসেছেন। র‌্যাব-পুলিশ গ্রেপ্তার দেখিয়েছে ছয়জনকে। পাঁচজন এখনো নিখোঁজ। তাঁরা হলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, বিএনপি নেতা সৈয়দ সাদাত আহমেদ, কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান ও কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইশরাক আহমেদ।​

সাম্প্রতিক সময়ে নিখোঁজদের মধ্যে উৎপলের আগে আড়াই মাস নিখোঁজ থাকার পর পরিবারের কাছে ফেরেন ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়। অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে তিনিও কোনো তথ্য দিতে পারেননি। কিছু মুখোশধারী মানুষের কাছে তিনিও জিম্মি ছিলেন বলে জানিয়েছেন।

কারা এই মুখোশধারী তাদের সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারছে না আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

উৎপলের নিখোঁজ হওয়া ও ফিরে আসার এই রহস্য উদ্‌ঘাটন এবং মুখোশধারীদের খুঁজে বের করা জরুরি বলে মনে করেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল।

“কারা এটা করেছে তা শনাক্ত করতে না পারলে শঙ্কার পরিবেশ থেকে যাবে। পরিবার না চাইলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখতে হবে নিখোঁজ হয় কেন” বেনারকে বলেন বুলবুল।

তিনি মনে করেন, “এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিরাপত্তা দেয়া। কারা এই দায়িত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে, আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করছে? এটা নির্ধারণ করতে না পারলে স্বস্তি আসবে না।”

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “উৎপল কোনো ধনাঢ্য ঘরের সন্তান নয়। সুতরাং টাকার জন্য তাকে জিম্মি করবে এটা প্রত্যয়যোগ্য নয়। মনে হচ্ছে সমাজের মধ্যে একটা গুপ্ত শক্তি আছে, যারা এসব করছে। এটা আতঙ্কের বিষয়।”

“ভিকটিমরা বের হয়ে এসেও তাদের সম্পর্কে কিছু বলতে পারছে না। সরকার, নিরাপত্তাদানকারী বাহিনী, সাধারণ মানুষ— কারও জন্যই এটা ভাল লক্ষণ নয়,” বেনারকে বলেন সাখাওয়াত।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।