ফিরে এসে মুবাশ্বার হাসান: অপহরণের ঘটনা জীবনের একটি ‘রহস্য’

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.12.22
ঢাকা
ফিরে আসার পর দক্ষিণ বনশ্রীর বাসায় সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন মুবাশ্বার হাসান ফিরে আসার পর দক্ষিণ বনশ্রীর বাসায় সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন মুবাশ্বার হাসান। ২২ ডিসেম্বর ২০১৭
[বেনারনিউজ]

কেন তাঁকে অপহরণ করা হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো স্বচ্ছ ধারণা ছাড়াই প্রায় দেড় মাস পর ফিরে এসে ঘটনাটিকে জীবনের একটি ‘রহস্য’ বলে বর্ণনা করলেন জঙ্গিবাদ নিয়ে গবেষণা করা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুবাশ্বার হাসান সিজার।

মাত্র দুইদিন আগে আড়াই মাস পর ফিরে আসা সাংবাদিক উৎপল দাসের মতো মুবাশ্বারও অপহরণ ঘটনায় কোনো মামলা করতে ইচ্ছুক নন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এদিকে ভুক্তভোগী মামলা না করলে এ বিষয়ে সরকারও তদন্ত করবে না বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

পুলিশ ও পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, বৃহস্পতিবার রাতে অপহরণকারীরা মুবাশ্বারকে এয়ারপোর্ট রোডে একটি মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।

গত ৭ নভেম্বর ঢাকার আগারগাঁ থেকে মুবাশ্বার হাসানকে অপহরণ করা হয়। তবে কেন তাঁকে অপহরণ করা হয়েছিল এ বিষয়ে কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই মুবাশ্বারের।

হতে পারে “টাকা পয়সার কারণে”, হতে পারে “না বুঝেই” তারা তাঁকে অপহরণ করেছে জানিয়ে মুবাশ্বার বলেন, “মানুষের জীবনে কিছু রহস্য থাকে, হয়ত এটাও তার মধ্যে একটা।”

মুবাশ্বার সাংবাদিকদের বলেন, মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে দেওয়ার আগে অপহরণকারীরা তাঁকে বলে, “তুই যাগা, পেছন ফিইরা তাকাইলে মাইরা ফালামু।”

এর আগে দুই মাসের বেশি সময় আটক থাকার পর মঙ্গলবার রাতে অপহরণকারীরা উৎপল দাসকে নারায়ণগঞ্জের ভুলতার কাছে মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে দিয়ে বলেছিল “সোজা চলে যা। পেছনে তাকালে গুলি করব।”

মুবাশ্বারের বোন তামান্না তাসনিম বেনারকে জানান, “মুবাশ্বার একটি সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করে দক্ষিণ বনশ্রীর বাসায় পৌঁছান রাত একটার দিকে।”

মুবাশ্বার হাসান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল মৌলবাদ ও রাজনীতি।

কর্মজীবনের শুরুর দিকে তিনি কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রামের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

তদন্ত করবে না সরকার

মুবাশ্বার হাসান ও উৎপল দাসের হারিয়ে যাওয়া এবং কিছুদিন পর ফিরে আসার ঘটনা সরকার তদন্ত করবে কি না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেনারকে বলেন, “তদন্ত করতে হলে যারা ভিকটিম তাদের বলতে হবে যে তাঁকে জোর করে অপহরণ করা হয়েছে বা তুলে নেয়া হয়েছে। উনারা তো আর বলছেন না।”

তিনি বলেন, “উনারা যদি মামলা করে অভিযোগ করেন তাঁদের অপহরণ করা হয়েছে বা তুলে নেয়া হয়েছে তাহলে আমরা বিষয়গুলো তদন্ত করব।”

এদিকে শুক্রবার সকালে মুবাশ্বার হাসানের বাসায় গিয়ে তাঁর সাথে কথা বলে এসে অপহরণের ঘটনায় মুবাশ্বার মামলা করতে চান না বলে জানিয়েছেন খিলগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জাহাঙ্গীর কবির খান।

তিনি বেনারকে বলেন, “তিনি অপহরণকারীদের কাউকে চিনতে পারেননি। এখন উনি চাইলে অপহরণের মামলা করতে পারেন। কিন্তু উনি বলেছেন মামলা করতে চান না। তাই তাঁকে আদালতে তোলার প্রয়োজন নেই।”

এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বেনারকে বলেন, “সাধারণত যা ঘটছে তা হলো কিছু মানুষকে কে বা কারা উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পর কেউ ফিরে আসছে; আবার কেউ ফিরে আসছে না”।

“যারা ফিরে আসছে তারা কিছু বলছে না। আবার রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে না বা ঘটনাগুলো সম্পর্কে জনগণকে কিছু জানানো হচ্ছে না,” বলেন তিনি।

প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে মন্তব্য করে সুলতানা কামাল বলেন, “আমি মনে করি, রাষ্ট্র এসকল ঘটনার দায়িত্ব এড়াতে পারে না।”

“অন্যথায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দুর হবে না,” বলেন সুলতানা কামাল।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত জুলাই মাসে এক প্রতিবেদনে জানায়, শুধু ২০১৬ সালেই বাংলাদেশে ৯০ জন নিখোঁজ হয়েছিলেন। যাদের মধ্যে পরবর্তীতে ২১ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়।

বেশিরভাগকেই নিখোঁজ হবার কয়েকমাস পর গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হলেও অনেকেই এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, গত চার মাসে ১৫ জন নিখোঁজ হন। তাঁদের মধ্যে মুবাশ্বার হাসানসহ পাঁচজন ফিরে এসেছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার দেখিয়েছে ছয়জনকে।

চারজন এখনো নিখোঁজ আছেন। এঁরা হলেন- সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, বিএনপি নেতা সৈয়দ সাদাত আহমেদ, কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমান ও কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইশরাক আহমেদ।

অনেক দিন পর আলো দেখছি

ফিরে আসার পর মুবাশ্বার হাসান শুক্রবার সকালে তাঁর বাসার সামনে কয়েক মিনিট সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।

তিনি জানান, অপহরণ হওয়ার দিন আগারগাঁওয়ে ইউএনডিপি ভবনে একটি সভা শেষ করে বাসায় ফেরার জন্য তিনি একটি উবার গাড়ি ডাকেন। তিনি গাড়িতে বসে ফোন নিয়ে কাজ করছিলেন। এমন সময় কয়েকজন ব্যক্তি তাঁকে বহনকারী গাড়িটি আটকে দিয়ে বলে, এটা চোরাই গাড়ি।

মুবাশ্বার গাড়ি থেকে নেমে আরেকটি গাড়ি ভাড়া করার চেষ্টা করতেই পেছন থেকে কেউ একজন তাঁর চোখে এক ধরনের মলম লাগিয়ে দেয়। এরপর অপহরণকারীরা তাঁকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে চলে যায়। গাড়ির ভেতর তাঁর মুখ চেপে অজ্ঞান করা হয়। জ্ঞান ফেরার পর দেখেন তিনি একটি ঘরে আটক অবস্থায় আছেন।

তিনি বলেন, তাঁকে একটি নির্জন ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। জায়গাটা কোথায় তা তিনি বলতে পারেননি। তাঁকে প্রতিদিন দেওয়া হতো রেস্তেঁরার ঠাণ্ডা খাবার। মাঝে মাঝে অপহরণকারীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করত তাঁকে মেরে ফেরে ফেলা হবে, নাকি ছেড়ে দেওয়া হবে।

যে ব্যক্তি তাঁকে প্রতিদিন খাবার দিত তাঁর মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা থাকত বলে জানান মুবাশ্বার।

“বিছানায় ছিল ময়লা তোশক। জানালা ছিল, তবে তা ছিল বাইরে থেকে সিল করা। পাশে একটা রুম ছিল। সেখানে চার/পাঁচজন কথা বলত,” বলেন মুবাশ্বার।

অন্ধকার ঘরে আটকে রাখার কারণে তিনি কিছু দেখতে পারেননি বলে জানান।

“আমি অনেক দিন পর দিনের আলো দেখছি,” নিজের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন মুবাশ্বার।

অপরহৃত না হলে বোঝা যাবে না বিষয়টা

ফিরে আসার ঘটনা প্রসঙ্গে মুবাশ্বার জানান, নির্জন স্থান থেকে তাঁকে গামছা দিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় এক থেকে দেড় ঘন্টা গাড়িতে চড়িয়ে এনে এয়ারপোর্ট রোডে নামিয়ে দেওয়া হয়।

“গামছা বাঁধা অবস্থায় রাতে নামায়ে দিসে,” বলেন তিনি।

তাঁর কাছে থাকা ২৭ হাজার টাকা অপহরণকারীরা আগেই নিয়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এয়ারপোর্ট রোড থেকে ফেরার জন্য আমার কাছে টাকা-পয়সা ছিল না।”

অপহরণকারীরা দুয়েকবার টাকা পয়সা নিয়ে কথা বললেও ওরা মুক্তিপণে আগ্রহী ছিল কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত নন মোবাশ্বার।

তিনি বলেন, “মাঝখানে তারা বলেছিল টাকা-পয়সার ব্যাপারে তোর ফ্যামিলি বা বড় কেউ আছে কি না, ফোন দে।”

“ওরা মুক্তিপণ চায় কি চায় না, আই ডোন্ট নো," বলেন মুবাশ্বার।

অপহৃত না হলে ওই পরিস্থিতি অনুমান করা সম্ভব নয় জানিয়ে মুবাশ্বার বলেন, “কিডন্যাপ না হইলে বুঝা যাবে না বিষয়টা কতটুকু আনরিয়েল।”

মুবাশ্বার এয়ারপোর্ট রোড থেকে একটি সিএনজি নিয়ে বাসার সামনে এসে সিএনজিওলার ফোন থেকে ভাড়ার টাকার জন্য তাঁর বাবাকে ফোন দেন বলে জানান।

মুবাশ্বারের বোন তামান্না তাস‌নিম ব‌লেন, মুবাশ্বার যে পোশাকে নি‌খোঁজ হ‌য়ে‌ছি‌লেন, সে পোশাকেই ফি‌রে‌ছেন। তবে তি‌নি শারী‌রিকভা‌বে সুস্থ আছেন।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রাপ্তি রহমান

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।