পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খন্ডে অস্ত্র ছেড়ে পুনর্বাসনে আকৃষ্ট হচ্ছে মাওবাদীরা

কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল
2017.02.16
পুরস্কার ঘোষিত মাওবাদী নেতা কানুরাম মুন্ডা ঝাড়খন্ড পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পুরস্কার ঘোষিত মাওবাদী নেতা কানুরাম মুন্ডা ঝাড়খন্ড পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৭।
বেনার নিউজ

সশস্ত্র মাওবাদী আন্দোলন মোকাবেলায় পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খন্ডের রাজনৈতিক কৌশলের ফলে গত দুই বছরে তিন শতাধিক মাওবাদী নেতা ও ক্যাডার পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।

এই ধারাবাহিকতায় বুধবার ঝাড়খন্ডে আত্মসমর্পণ করেন মাওবাদীদের পশ্চিমবঙ্গ-ওড়িশা-ঝাড়খন্ড বর্ডার রিজওনাল কমিটির সম্পাদক কানুরাম মুন্ডা ওরফে মঙ্গলজী।

ক্ষমতায় আসার পরই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাওবাদীদের মূল স্রোতে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাদের উপযুক্ত আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন।

ঝাড়খন্ড রাজ্য থেকেও দেওয়া হয়েছিল একই রকম প্রতিশ্রুতির ঘোষণা।

এর ফলেই পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খন্ডে মাওবাদী নেতা ও কর্মীরা আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেন।

“পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকার আমাদেরকে পুরোনো অতীত ভুলে স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ দিচ্ছে। তাই আমরা এই সুযোগ গ্রহণ করেছি।”

২৫ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের সময় দেওয়া বিবৃত্তিতে এমন কথাই জানিয়েছিলেন মাওবাদীদের পশ্চিমবঙ্গ-ওড়িশা-ঝাড়খন্ড বর্ডার রিজওনাল কমিটির সদস্য রঞ্জিত পাল ও তার স্ত্রী অনিতা।

একই সাথে, হিংসাত্মক আন্দোলন করে জনগণ ও পরিবারের ভালো করা সম্ভব নয়, সেটা তারা বুঝতে পেরেছেন বলেও বিবৃতিত উল্লেখ করেন রঞ্জিত ও অনিতা দম্পতি।

পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডিজি সুরজিৎ পুরকায়স্থর কাছে আত্মসমর্পণ করছেন সস্ত্রীক রঞ্জিত পাল। জানুয়ারি ২৫, ২০১৭।
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডিজি সুরজিৎ পুরকায়স্থর কাছে আত্মসমর্পণ করছেন সস্ত্রীক রঞ্জিত পাল। জানুয়ারি ২৫, ২০১৭।
বেনার নিউজ
বুধবার পঞ্চাশ বছর বয়সী কানুরামের সাথে একজন নারীসহ অন্য যারা আত্মসমর্পন করেন তারা হলেন, ফোগর মুন্ডা, চুন্নু মুন্ডা, ভোগলু সিং মুন্ডা, জিতেন মুন্ডা, শঙ্কর ও কাজল।

ঝাড়খন্ডের ঘাট শিলা মহকুমার গোরাবান্ধা পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন জিয়ানে পূর্ব সিংভুমের সিনিয়র পুলিশ সুপার অনুপ টি ম্যাথুর কাছে কানুরামসহ অন্যরা আত্মসমর্পণ করেন।

ঝাড়খন্ড পুলিশের অন্যতম শীর্ষ আধিকারিক প্রভাত কুমার সাংবাদিকদের কাছে এটিকে বিরাট সাফল্য বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, নিজের গ্রামে গ্রামবাসীদের সামনে এই প্রথম একজন মাওবাদী নেতা আত্মসমর্পণ করেছেন।

পুলিশ জানিয়েছে, এক দশক ধরে পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর লাগোয়া ঝাড়খন্ড রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকায় কানু ও তার দলবল ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল বলে অভিযোগ। গোরাবান্ধা স্কোয়াডের প্রধান কানুরাম দু’বছর আগে মাওবাদী দলের বাংলা-ওড়িশা-ঝাড়খন্ড বর্ডার রিজিওনাল কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন।

পশ্চিমবঙ্গের এক গোয়েন্দা কর্তা বেনারকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কানুরাম মুন্ডা ও তার সঙ্গীদের আত্মসমর্পণের ফলে মাওবাদীদের বাংলা-ওড়িশা-ঝাড়খন্ড বর্ডার রিজওনাল কমিটি ও গোরাবান্ধা স্কোয়াডের ক্ষমতা বলে আর কিছু থাকবে না।

পুলিশের সূত্রমতে, কানুরামের মাথার দাম ঘোষণা করা হয়েছিল ২৫ লাখ রুপি। তার সঙ্গী ফোগর মুন্ডার মাথার দাম পুলিশ ঘোষণা করেছিল ১০ লাখ রুপি। বাকিদের প্রত্যেকের জন্য দুই লাখ রুপি করে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল।

উল্লেখ্য, কানুরামের বিরুদ্ধে খুন-নাশকতার ৪৭টি মামলা রয়েছে।

রাজনৈতিক আশ্বাসই আত্মসমর্পণের কারণ

গত ২৫ জানুয়ারি কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন পশ্চিমবঙ্গ-ওড়িশা-ঝাড়খন্ড বর্ডার রিজওনাল কমিটির সদস্য রঞ্জিত পাল ও তার স্ত্রী অনিতা।

পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খন্ডে খুন-নাশকতার অন্তত ৫০টি মামলায় অভিযুক্ত এই মাওবাদী দম্পতি। পুলিশ রঞ্জিত পালকে ধরতে ৩০ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।

কলকাতা পুলিশের ডিজি সুরজিৎ পুরকায়স্থ বেনারকে জানান, পশ্চিমবঙ্গে গত দুই বছরে ২১৯ জন মাওবাদী আত্মসমর্পণ করেছেন।

অন্যদিকে ঝাড়খন্ড পুলিশ আধিকারিক প্রভাত কুমার বেনারকে জানিয়েছেন, তাদের কাছে প্রায় একশ জন মাওবাদী গত দুই বছরে আত্মসমর্পণ করেছেন।

এর বাইরে গত বছরের ১৭ অক্টোবর রাঁচিতে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন নিষিদ্ধ পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের নয়জন মাওবাদী নেতা ও ক্যাডার।

কানুরাম বা রঞ্জিতের মতো মাওবাদী নেতাদের আত্মসমর্পণের পেছনে কাজ করেছে রাজনৈতিক নেতাদের আশ্বাস। রাজ্য সরকার বা পুলিশ তাদের প্রতি প্রতিহিংসামূলক মনোভাব নেবে না, এমন আশ্বাস পেয়েই তারা এগিয়ে এসেছেন বলে দাবি রঞ্জিতের আত্মসমর্পণের সঙ্গে যুক্ত পশ্চিমবঙ্গের এক মন্ত্রীর, যিনি নাম, প্রকাশ করতে চান না।

তার মতে, শুধু পুলিশি অভিযান চালিয়ে নয়, শান্তিপূর্ণভাবেও দমন করা যায় মাওবাদীদের।

মাওবাদীদের জন্য পুনর্বাসন প্যাকেজ

আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রাথমিকভাবে ৫০ হাজার রুপির আর্থিক অনুদান দিচ্ছে। এ ছাড়া ২ লাখ রুপির দীর্ঘ মেয়াদি আমানতের সার্টিফিকেটও দেওয়া হচ্ছে। তবে পরিপূর্ণ সংশোধন হলে তবেই সেই আমানতের অর্থ তারা হাতে পাবেন মেয়াদ শেষে।

পুলিশ লাইনে হোম গার্ড পদেও এদের নিয়োগ করা হচ্ছে। ঝাড়খন্ডেও একইভাবে আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

তবে আত্মসমর্পণকারীদের বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলো এখনই প্রত্যাহার করা হচ্ছে না। মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে আত্মসমর্পণের শর্তমতো তাদের পরিপূর্ণ সংশোধন হওয়া না হওয়ার ওপর।

ভারতে মাওবাদী আন্দোলন

সশস্ত্র গণ আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের ডাক দিয়ে ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি থেকে এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। সে সময় এই আন্দোলন সারা দেশে ছাত্র-যুবাদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল। পরবর্তী সময়ে আদর্শগত প্রশ্নে বহু দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল এই আন্দোলন।

তবে ২০০৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সিপিআইএমএল, পিপলস ওয়ার গ্রুপ ও মাওইস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার মিলিত হয়ে তৈরি করে বর্তমানের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি।

২০১৩ সালের সরকারি তথ্যে জানানো হয়েছিল যে, গোটা দেশের ৭৬টি জেলায় মাওবাদী আন্দোলনের বিস্তৃত প্রভাব রয়েছে। আর ১০৬টি জেলা মাওবাদী প্রভাবিত এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের ৫টি জেলা এবং ঝাড়খন্ডের ২০টির মতো জেলা মাওবাদী উপদ্রুত এলাকা বলে চিহ্নিত।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব মানুষকে সশস্ত্র আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে মাওবাদীরা আন্দোলনের নামে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা বাহিনীর বিরুদ্ধে জেহাদ অব্যাহত রেখেছে।

তবে সাম্প্রতিকালে মাওবাদীদের দলে দলে আত্মসমর্পণের কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে মাওবাদী প্রভাবিত গণ সংগঠনের কর্মী সুবেশ দাশ বেনারকে বলেন, “মাওবাদী আন্দোলনে দিশার অভাব প্রবল হয়ে উঠেছে। কিষেণজির মতো নেতার মৃত্যুর পর শূন্যতা থেকে হতাশা তৈরি হয়েছে।”

তার মতে, মাওবাদীদের খুনের রাজনীতি অনেকে আর মানতে পারছে না। দলের মধ্যে বিরোধের পরিণতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়ার ঘটনাও আত্মসমর্পণের আরেকটি কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য মাওবাদীদের শীর্ষ গেরিলা নেতা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজি ২০১১ সালের নভেম্বরে ভারতের যৌথ বাহনীর এক অভিযানে তিন সহযোগীসহ পষ্চিম মেদিনীপুর জেলার বুড়িশোল জঙ্গলে নিহত হন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।