হাজার কোটি টাকা পাচারে জড়িত পিকে হালদারকে দেশে ফেরানোর তোড়জোড়
2022.05.16
ঢাকা ও কলকাতা
দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারে অভিযুক্ত প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার) ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁকে কীভাবে দেশে ফিরিয়ে আনা যায় তা নিয়ে তৎপরতা শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
চারটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থেকে নামে-বেনামে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও ভারত এবং কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে টাকা পাচারের সাথে জড়িত পিকে হালদারকে দেশে ফেরানো কতটা সহজ হবে-সেই প্রশ্ন উঠলেও দেশের আর্থিক খাতে কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত সাবেক এই ব্যাংকারকে ফিরিয়ে আনার পথ খুঁজছেন সংশ্লিষ্টরা।
“যদিও এখনও আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানতে পারিনি। কিন্তু এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, পিকে হালদার ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। খবরটি জানার পর থেকেই তাকে কীভাবে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়, সেই তৎপরতা আমরা শুরু করেছি,” বেনারকে বলেন দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের আইন এবং দুই দেশের মধ্যকার চুক্তিগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে দুদকের ৩৪ মামলার এই আসামিকে ফিরিয়ে আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে দুদক।
ইন্টারপোলের সাথে যোগাযোগ শুরু: দুদক
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে দুদকের মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খান সাংবাদিকদের বলেন, পিকে হালদারকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
তিনি জানান, বাংলাদেশ পুলিশের ইন্টারপোল ডেস্ক ভারতীয় ইন্টারপোল বডির সাথে যোগাযোগ করে “আসামিকে ফেরত আনার পদক্ষেপ নিয়েছে।”
এ ছাড়া ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে দেশটির আদালতের সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও জানান দুদকের এই কর্মকর্তা।
এদিকে পিকে হালদারকে দেশে ফেরানোর বিষয়ে সরকার “সক্রিয়ভাবে কাজ করছে,” বলে বেনারকে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
ফেরা বিলম্ব হতে পারে
ভারত থেকে পিকে হালদারকে ফিরিয়ে আনতে কত সময় লাগতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে দুদক কর্মকর্তা মাহবুব জানান, “তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন।”
ভারতে মামলা হলে এর বিচার শেষ হতে কতদিন লাগবে অথবা বিচারের আগে তাঁকে ফেরত আনা যাবে কি যাবে না, তা এখনই নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না বলে জানান তিনি।
অপরদিকে পিকে হালদারকে দেশে ফেরানোর উদ্যোগ প্রসঙ্গে সোমবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, “এসব ক্ষেত্রে আমাদের একটি নীতি আছে। সেই অনুযায়ী আমরা কাজ করব।”
“প্রথমে ভারত সরকার আমাদের জানাবে, এই লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। হয়তো শাস্তি দেবে। এরপর হয়তো আমাদের বলবে যে, শাস্তির মেয়াদ বাংলাদেশে এসে কমপ্লিট করবে। এটা আমরা অন্যান্য দেশেরটাতে করি, তারাও আমাদের সাথে করবে,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ভারতের বিশিষ্ট আইনজীবী বিশ্বজিৎ মুখার্জীর মতে “বাংলাদেশ সরকার অনুরোধ জানালে অবশ্যই অপরাধীদের ফেরত পাঠানো সম্ভব।”
“এ ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রকের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। তবে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে প্রত্যর্পণ করা যাবে,” বেনারকে বলেন বিশ্বজিৎ মুখার্জী।
তবে ভারতে অপরাধীদের অপরাধের প্রাথমিক তদন্তের পরই ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করা যাবে বলে জানান তিনি।
ভারতীয় অর্থসংক্রান্ত তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) শনিবার সকালে পিকে হালদার ও তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তারের পর স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশের পাসপোর্টের বাইরে ভারত ও উত্তর আমেরিকার ক্যারিবিয় অঞ্চলের দ্বীপরাষ্ট্র গ্রেনেডার পাসপোর্ট পাওয়া গেছে তাঁর কাছে।
পিকে হালদার ভারতে শিব শংকর হালদার নামে ভারতীয় ভোটার আইডি ও আধার কার্ড সংগ্রহ করেছিলেন বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায় ইডি।
২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবরে পিকে হালদারসহ কয়েকজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও তার আগেই যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে পিকে হালদার দেশ ত্যাগ করেন বলে বেনারকে জানান দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান।
তিনি বলেন, সে সময় ভারত হয়ে কানাডায় পাড়ি জমান পিকে হালদার এবং কানাডা থেকে একবার দেশে ফেরার চেষ্টাও করেন তিনি।
দেশে ফিরতে চান পিকে হালদার
সোমবার কলকাতার বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় পিকে হালদারকে।
চেকআপ শেষে ইডির কার্যালয়ে ফেরত নেয়ার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পিকে হালদার জানান, তিনি বাংলাদেশে ফিরতে চান।
“আমি দেশে ফিরতে চাই। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো ভিত্তিহীন,” বলেন পিকে হালদার।
চার প্রতিষ্ঠান লুটপাটে ৮৩ ব্যক্তির চক্র
দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বেনারকে বলেন, পিকে হালদার ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে তাঁর প্রায় ৮৩ জন আত্মীয় ও সহযোগীকে নিয়ে চারটি আর্থিক কোম্পানির সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন।
এই চার কোম্পানি হল; ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)।
গুলশান জানান, এই ৮৩ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব জব্দ করার পাশাপাশি পিকে হালদারের প্রায় এক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তিও জব্দ করেছে দুদক।
পিকে হালদারের ১২ সহযোগীকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে দুদক। তাঁরা প্রত্যেকেই বর্তমানে জেলে আছেন বলে জানান, গুলশান।
দুদকের তদন্তে জানা গেছে, পিকে হালদারের মা লীলাবতী হালদার ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পিকে হালদার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং পরে ব্যবসায় প্রশাসন নিয়ে পড়াশোনা করেন।
২০০৮ সাল পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিতে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে তিনি রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হন। এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন।
২০১৯ সালে সরকার ও দুদকের ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের সময় আলোচনায় আসনে পিকে হালদার।