রিজার্ভের অর্থ চুরির চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.04.01
160401-BD-money-620.jpg কিম ওয়ংয়ের ফেরত দেওয়া অর্থের পাশে বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনের কর্মকর্তারা। ৩১ মার্চ ২০১৬।
ইনকোয়ারার

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় দেশের বাইরে বেশ কিছু অগ্রগতি হচ্ছে। ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা থেকে একে একে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

বাংলাদেশে এ নিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা (সিআইডি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে পৃথক তদন্ত চলছে। দুটি তদন্ত কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইনের সিনেটে শুনানি চলছে। অর্থ চুরির অন্যতম হোতা ব্যবসায়ী কিম ওয়ং গত বৃহস্পতিবার দেশটির অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিলে (এএমএলসি) ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার ফেরত দিয়েছেন।

এরই মধ্যে শুক্রবার নতুন তথ্য প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি হয়ে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কায় শালিকা ফাউন্ডেশনে। ওই ফাউন্ডেশনের প্রধান গমেজ শালিকা পেরেরা রয়টার্সের কাছে দাবি করেছেন, তিনি তাঁর বন্ধুর মাধ্যমে ওই অর্থ পেয়েছিলেন।

শ্রীলঙ্কার আদালত ইতিমধ্যে শালিকা ফাউন্ডেশনের ছয় পরিচালকের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ ঘটনায় দেশটিতে মামলা দায়ের হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে মোট ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয় গত ফেব্রুয়ারির ৪ থেকে ৫ তারিখের মধ্যে। এর মধ্যে ২ কোটি ডলার শ্রীলঙ্কায় শালিকা ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা হয়েছিল। ফিলিপাইনে যায় আট কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, দু-এক দিনের মধ্যেই ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের দুই কর্মকর্তা ফিলিপাইনে যাবেন। গতকাল ওই দুই কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন গভর্নর ফজলে কবির।

শালিকার সাক্ষাৎ​কার

রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শালিকা দাবি করেছেন, শ্রীলঙ্কায় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ কয়েকটি প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) কাছ থেকে ওই অর্থ তাঁকে এনে দেওয়ার কথা বলেছিলেন এক বন্ধু। কিন্তু সেটি যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চুরি করা অর্থ, সে বিষয়ে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না।

অর্থ চুরির ঘটনার পর প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে কথা বললেন শালিকা পেরেরা। তিনি রয়টার্সকে বলেন, বন্ধুর কথামতো জাইকা থেকে তাঁর প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ২ কোটি ডলার আসবে, এটা তাঁর কাছে প্রত্যাশিত ছিল। তবে তিনি বলেন, জাইকার সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ ছিল না। পুরো বিষয়টি করে দিয়েছেন তাঁর এক ব্যবসায়ী বন্ধু, যাঁর সঙ্গে জাপানের ‘ভালো যোগাযোগ’ আছে।

তবে রয়টার্স জানিয়েছে, শালিকা পেরেরা তাঁর বন্ধুর যে ফোন নম্বর ও ই-মেইল ঠিকানা দিয়েছেন, তা ব্যবহার করে তাঁর ওই বন্ধুর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

আর জাইকার মুখপাত্র নাওয়োকি নেমোতো বলেছেন, শালিকা ফাউন্ডেশন নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই।

অর্থ ফেরত দিলেন কিম

গত মঙ্গলবার ফিলিপাইনের সিনেট শুনানিতে হাজির হয়ে কিম অর্থ ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। বৃহস্পতিবার তিনি ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার ফেরত দেন। র‍্যাপলার অনলাইন ও ফিলিপাইনের ইনকোয়ারার পত্রিকা সূত্রে এই খবর পাওয়া গেছে।

ফিলিপাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জন গোমেজ ও দ্বিতীয় সচিব প্রবাস লামারং অর্থ ফেরত দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন।

ইস্টার্ন হাওয়াই লেইজার কোম্পানি লিমিটেডের প্রেসিডেন্ট ও মহাব্যবস্থাপক কিম। হংকংভিত্তিক কোম্পানিটি ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

গত মঙ্গলবার ফিলিপাইনের সিনেটের ব্লু রিবন কমিটির শুনানিতে কিম ওয়ং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে ওই অর্থ ফেরত দিতে চান।

তবে শুনানিতে কিম এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছিলেন। এ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন, এমন দুই সন্দেহভাজনের নাম উল্লেখ করেন কিম ওয়ং।

তাঁরা হলেন গাও সু হুয়া ও দিং ঝিজে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পাচার হওয়া টাকা ক্যাসিনোতে ওই দুজন নিয়ে এসেছিলেন।

এদিকে রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) জুপিটার শাখার বরখাস্ত হওয়া জ্যেষ্ঠ কাস্টমার রিলেশনস কর্মকর্তা অ্যাঞ্জেলা তোরেস ও জুপিটার মাকাতি শাখার ব্যবস্থাপক মায়া দেগুইতোর বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ বৃহস্পতিবার মামলা করেছেন চীনা ব্যবসায়ী উইলিয়াম সো গো। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর সই জালিয়াতি করে ওই দুজন ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন।

চুরি যাওয়া অর্থ ফিলিপাইন থেকে পাচারে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে ২২ মার্চ মায়া ও তাঁর সহকারী অ্যাঞ্জেলা তোরেসকে বরখাস্ত করে রিজাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

তদন্ত কমিটির মুখোমুখি দুই ডেপুটি গভর্নর

রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হয়েছেন সাবেক দুই ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম ও নাজনীন সুলতানা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁদের ডেকে কথা বলেন তদন্ত কমিটির প্রধান ও সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনসহ অন্য সদস্যরা।

এর আগে কমিটির পক্ষ থেকে তাঁদের তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। সেই অনুযায়ী, গতকাল নির্ধারিত সময়ে আলাদা আলাদাভাবে তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হন সাবেক দুই ডেপুটি গভর্নর।

রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনা তদন্তে গত ১৫ মার্চ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক মোহাম্মদ কায়কোবাদ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব গকুল চাঁদ দাস।

জানা গেছে, সাবেক দুই ডেপুটি গভর্নরের কাছে তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানতে চান কে, কবে, কীভাবে রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনাটি জেনেছেন এবং জানার পর কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছেন। এ সময় তাঁরা তদন্ত কমিটিকে এ বিষয়ে বিস্তারিত অবহিত করেন।

রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে আবুল কাশেম ও নাজনীন সুলতানাকে গত ১৫ মার্চ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

“এ বিষয়ে আমরা কথা বলতে চাই না। তদন্ত শেষ হওয়ার পর সবকিছু জানানো হবে,” বেনারকে জানান তদন্ত কমিটির প্রধান মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

তবে সব টাকা ফেরত আসবে কিনা, সেই সংশয় রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে। বিভিন্ন সংগঠন এ জন্য সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করে আসছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।