ভোর ছয়টা বাজার কয়েক মিনিট পরেই শুরু হয়েছিল রমনা বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। সামনের সারি থেকে পেছনে তাকাতে মনে হলো অনুষ্ঠানস্থলে জনসমাগম কিছুটা কম।
এই রেশ ছিল প্রায় দিনভর। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরও কোথায় যেন একটু ভয়—কিছুটা সংশয় উৎসবপ্রিয় বাঙালিকে পিছু টেনে ধরেছিল পহেলা বৈশাখের দিনে। ইসলামভিত্তিক কয়েকটি দলের আন্দোলনের হুমকি ও বিরূপ মন্তব্য ছাড়াও নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি অনেকেই পছন্দ করেননি।
বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জঙ্গিবাদের উত্থান, কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক দলগুলোর সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতাদের পক্ষ থেকে আন্দোলনের হুমকি, তাদেরই দাবির মুখে মাদ্রাসা শিক্ষার সনদকে স্বীকৃতি প্রদান, সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্য অপসারণের দাবির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সায়, আওয়ামী লীগের শোভাযাত্রা বর্জন, চট্টগ্রামে পোড়া মবিল ছুড়ে দেয়ালচিত্র নষ্ট করা—ধারাবাহিক এসব ঘটনা অনেকের মধ্যে রেখাপাত করে।
ছায়ানটের প্রধান সানজীদা খাতুন তো প্রকাশ্যেই বললেন, “আবার একটি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হয়েছে এখন।”

সেই পঞ্চাশ বছর আগে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের শুরু। সে সময় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন করে ছায়ানট। ওই আন্দোলন যে ফুরিয়ে যায়নি, সে কথাই গতকাল শুক্রবার ঘুরেফিরে এলো বারবার।
“সাম্প্রদায়িকতার উত্থান প্রতিরোধে বাঙালি সংস্কৃতির বাণী নিয়ে আমাদের এবার সাধারণ মানুষের কাছে যেতে হবে,” সানজীদা খাতুন বলেন ছায়নটের ওই অনুষ্ঠানে।
ছায়ানটের আয়োজনের এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আনন্দ, বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধান ও অসাম্প্রদায়িকতা।’ আর মঙ্গল শোভাযাত্রার বাণী ছিল, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও শোভাযাত্রায় শান্তি ও মানবতার কথাই বারবার উচ্চারণ করা হয়।
শোভাযাত্রার সামনে-পেছনে ছিল ঢাকের বাদ্যের তালে তালে নৃত্য, আর হাতে হাতে ছিল বাহারি মুখোশ। টেপা পুতুল আর বাঁশের কাঠামোতে মাছ, পাখি ও হাতির মতো নানা লোকজ মোটিফে ফুটিয়ে তোলা হয় বাংলার ঐতিহ্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল গণভবনে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সেখানে সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি!
ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার পর এবারই প্রথম দেশের সর্বত্র শোভাযাত্রা করার আহ্বান জানানো হয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। আর এই শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয় কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম।
কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার শোভাযাত্রাটি। শুধু যে মঙ্গল শোভাযাত্রা ঘিরে বাড়তি সতর্কতা ছিল, তা-ই নয়। রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে গতকাল ছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যান চলাচলও ছিল নিয়ন্ত্রিত। প্রায় মাইল খানেক পথ পায়ে হেঁটে রমনার বটমূলে পৌঁছান মানুষ।
রমনায় পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে সকাল থেকে র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে নিরাপত্তা নজরদারি করেন।
রমনায় প্রবেশের মুখে পুলিশের অস্থায়ী অবস্থানকেন্দ্র থেকে দর্শনার্থীদের তল্লাশি করে ঢোকানো হয়। পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্য আব্দুল মালেক হাওলাদার বেনারকে বলেন, তাঁদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
“মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে উৎসব পালন করতে পারে সেজন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের সব থানা থেকে পুলিশ সদস্যদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা ভোর চারটা থেকে এখানে আছি,” জানান মালেক হাওলাদার।
পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, প্রতিটি উপজেলায় এবার কমপক্ষে ২০টি অনুষ্ঠান হয়েছে। পুলিশ আগেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়। এবার পুলিশের সঙ্গে অনুষ্ঠানের আয়োজকরাও স্বেচ্ছাসেবী সরবরাহ করেছেন।

কেউ কেউ মনে করছেন, নিরাপত্তার কড়াকড়িতে অনেকে উৎসাহ হারিয়েছেন। এর সঙ্গে আলোচনায় আসছে সরকারের তরফ থেকে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপসের চেষ্টার বিষয়টি। এ প্রসঙ্গে উদীচীর সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার কথা বলেন বেনারের সঙ্গে।
“দেখুন, এভাবে উৎসব হয় না। প্রথমত, বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বলে মনে করে। সেই আওয়ামী লীগ যখন শোভাযাত্রার অনুষ্ঠান থেকে পিছিয়ে আসে, স্বাভাবিকভাবেই মানুষ নিজেকে অভিভাবকহীন বলে মনে করতে শুরু করে। তার ওপর ছিল নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি,” ক্ষোভের সঙ্গে বলেন জামশেদ।
ভয়কে জয় করে উৎসবে
অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া কেউ কেউ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে খুশি। সোহেল রহিম ভোরে রমনার বটমূলে গিয়েছিলেন তাঁর ১৪ মাস বয়সী সন্তান কোলে নিয়ে। তিনি বেনারকে বলেন, “সব সময় আসি। এবারও এসেছি। সন্তানের বয়স কম বা হুমকি আমি গ্রাহ্য করি না,” জানান সোহেল।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এক পরিবারের নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ ৩৫ জন এসেছিলেন রমনায়। কথা হচ্ছিল সৈয়দ মানিকের সঙ্গে।
“আমরা উৎসব আনন্দ পছন্দ করি। কেউ ভয় দেখালে উৎসব করা বন্ধ করে দেব, এটা ভাবার কারণ নেই। আমাদের কেউ আটকে রাখতে পারবে না,” সৈয়দ মানিক বলেন।
একই পরিবারের সদস্য লাইজু হক বলছিলেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় তাঁরা স্বস্তি বোধ করছেন। তাঁদের ভালো লাগছে।
চট্টগ্রাম ছিল উৎ সবমূখর
শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রামের মানুষও। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস বিভাগের শিক্ষার্থীদের করা দেয়ালচিত্র দুর্বৃত্তরা পোড়া মবিল দিয়ে নষ্ট করে দেওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাঁরা নতুন করে ছবি এঁকেছেন। ডিসি হিলের অনুষ্ঠান থেকে শহরের সর্বত্র লাখো মানুষ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
“চট্টগ্রামের দেয়ালচিত্রে আঘাতের পর অনেকেই ভেবেছিল, মানুষ ভয় পাবে। সে ধারণা ঠিক হয়নি। শহরজুড়ে ছিল মানুষ আর মানুষ,” টেলিফোনে বলেন আবিদুর রহমান, যিনি চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাান্ড টেকনোলজির ছাত্র।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশজুড়ে গতকাল ছিল উৎসবের আমেজ। গত কয়েকমাসে বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলার পর এক ধরনের আতঙ্ক ছিল সবার মধ্যে। কোনও অঘটন না ঘটায় শেষ পর্যন্ত স্বস্তি লক্ষ করা যায় অনেকের মধ্যে।