সৌদি অর্থায়নে ৫৬০টি মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত, দেশে উগ্র ওয়াহাবি মতবাদ বিস্তারের আশঙ্কা

প্রাপ্তি রহমান
2017.04.28
ঢাকা
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম । জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম। এপ্রিল ২১, ২০১৭।
স্টার মেইল

সৌদি আরবের অর্থায়নে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণে সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে দেশে কট্টর ওয়াহাবি মতবাদ বিকশিত হওয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আরও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান আব্দুর রশীদ বেনারকে বলেন, “দেখা গেছে সৌদি আরবে চর্চা হওয়া ‘ওয়াহাবিজম’ অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ উসকানি দেয়। বাংলাদেশের মানুষেরা শান্তিপ্রিয় এবং সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধায় বিশ্বাসী। তাই মসজিদ নির্মাণের মাধ্যমে ওয়াহাবিজমের বিস্তার যাতে না ঘটে সেদিকে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে।”

“এই মসজিদগুলো নির্মাণের কোনো যৌক্তিকতা নেই। সৌদি অর্থায়নের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তারা হয়তো এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ওয়াহাবিজমকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই উদ্যোগে সংখ্যালঘুরা আরও অসহায় ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে।”

গত মঙ্গলবার বার্তা সংস্থা এএফপিকে এই কথাগুলো বলেন সুফি মুসলিমদের নেতা রেজাউল হক চাঁদপুরি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বেনারকে বলেন, “সংখ্যালঘুরা নানা ধরনের নির্যাতনের কারণে এমনিতেই যেখানে কোণঠাসা হয়ে থাকে, সেখানে এ ধরনের একমুখী উদ্যোগ তাদের আরও অসহায় করে দেয়।”

তিনি বলেন “যেখানে আমাদের মন্দিরগুলো প্রতিনিয়ত হামলার শিকার হচ্ছে, মূর্তি ভাঙচুর করা হচ্ছে, উপাসনালয় জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেখানে এ রকম একটি পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য অস্বস্তির।”

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ মসজিদ নির্মাণের পক্ষে থাকলেও প্রতি জেলায় সরকারিভাবে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের জন্য অন্তত একটি করে উপাসনালয় নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, সৌদি আরব ওয়াহাবি মতবাদের গোঁড়া সমর্থক ও প্রচারক।

বর্তমান সৌদি রাজবংশের পূর্বপুরুষ ইবনে সউদ এর সাথে একত্রিত হয়ে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব নামের একজন গোঁড়াপন্থী ধর্মবেত্তা অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এই মতবাদের সূচনা করেন। এই মতবাদে, যারা কোরানের বাণী আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে না, বা ইসলামের মূল নীতিগুলোকে কঠোরভাবে পালন করে না, তারাসহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর মনোভাব প্রদর্শন করা হয়ে থাকে।

মডেল মসজিদে যা থাকবে

সরকারের নেওয়া নতুন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি মসজিদে নারী ও পুরুষের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে পৃথক অজুখানা ও নামাজ ঘর। এ ছাড়া লাইব্রেরি, কোরআন পঠন ও তাহফিজ, শিশুদের শিক্ষা সুবিধা, অতিথিশালা, মৃতদেহ গোসল করানো এবং হজযাত্রী ও ইমামদের প্রশিক্ষণের সব সুবিধা থাকবে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সব মসজিদের নকশা হবে একইরকম। চলতি এপ্রিল মাস থেকে শুরু হওয়া এ প্রকল্প ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করবে।

৫৬০টি মসজিদ নির্মাণের এই বিশাল প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ৯ হাজার ৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮ হাজার ১৭০ কোটি টাকা দেবে সৌদি আরব, বাকি খরচ সরকার বহন করবে। প্রতিটি মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ কোটি টাকা।

সরকারের এই উদ্যোগ ইসলামের মূল চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে জানিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল বেনারকে বলেন, মসজিদগুলো নির্মাণের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে। ইতিমধ্যে জায়গা নির্বাচনসহ বেশ কিছু কাজও এগিয়ে রাখা হয়েছে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব ড. মো. আলফাজ হোসেন বেনারকে বলেন, তিনটি ক্যাটাগরিতে মসজিদগুলো নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ-ক্যাটাগরিতে ৬৪ জেলা ও চারটি সিটি করপোরেশন এলাকায় চার তলা বিশিষ্ট ৬৮টি মসজিদ নির্মাণ করা হবে। বি- ক্যাটাগরিতে ৪৭৬টি এবং সি ক্যাটাগরিতে নির্মাণ করা হবে ১৬টি মসজিদ।

সচিব বলেন, অধিকাংশ উপজেলায় বর্তমানে যেখানে ছোট ও জরাজীর্ণ মসজিদ রয়েছে এমন জায়গায় মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হবে। কোনো কোনো উপজেলায় উপজেলা কমপ্লেক্সের ভেতরের খালি জায়গায় করা হবে এই মসজিদ।

২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর জাতীয় সংসদে উল্লেখ করা এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বে মোট মসজিদের সংখ্যা ২৫ লাখের বেশি। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মসজিদ রয়েছে ভারতে। ১২০ কোটি জনসংখ্যার প্রতিবেশী এই দেশটিতে মসজিদের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। সেখানে ১৬ কোটির বাংলাদেশে মসজিদের সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি।

জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরকালে সংরক্ষিত আসনের এমপি বেগম মাহজাবিন মোরশেদের এক প্রশ্নের জবাবে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান বাংলাদেশে মসজিদের এই সংখ্যা জানান। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে পরিচালিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে মসজিদের সংখ্যা ২ লাখ ৫৩ হাজার ১৭৬টি। প্রায় আট বছরের মাথায় এখন ওই সংখ্যা বলা হয়, প্রায় ৩ লাখ।

দেশের আয়তনের সঙ্গে সংখ্যার তুলনা করলে বাংলাদেশেই মসজিদের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। আর নগরী হিসেবে রাজধানী ঢাকায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি মসজিদ। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হিসেবে, ঢাকায় মসজিদের সংখ্যা এখন প্রায় ছয় হাজার।

প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবেই সৌদির সহায়তা

ঢাকার শেরে বাংলা নগরের এনইসির সম্মেলন কক্ষে গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তাফা কামাল ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, গত বছর সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী সৌদি বাদশাহকে মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দেন। এই কাজে বাদশাহ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়।

সৌদি আরব বাংলাদেশের অন্যতম শ্রম বাজার। প্রায় দেড় বছর আগে কিছুটা তাড়াহুড়া করে সৌদি আরবের সাথে আইএসবিরোধী জোটে যোগ দেয় বাংলাদেশ। সৌদি আরব তাদের ভূখণ্ড থেকে মাইন অপসারণ, সীমান্ত সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা অবকাঠামোর বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছে।

চলতি বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাস্তবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।