সাংসদ লিটন হত্যায় নাটকীয় মোড়, সাবেক সাংসদ কাদের জড়িত
2017.02.27
গাইবান্ধার সাংসদ মনজুরুল ইসলাম লিটন হত্যার পর খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়ী করেছিলেন বিএনপি-জামায়াতের কর্মী–সমর্থকদের। পরিবারেরও অভিযোগও ছিল প্রায় একইরকম। আবার সন্দেহের তির ছিল স্ত্রী ও স্বজনদের দিকে। সন্দেহ থেকে বাদ পড়েননি দলের নেতারাও।
তবে হত্যাকাণ্ডের দু’মাসের মাথায় নাটকীয়ভাবে উল্টে গেল সবকিছু। পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন সাবেক সাংসদ ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা কাদের খান। দ্বিতীয়বার সাংসদ হওয়ার স্বপ্ন থেকে ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দিয়েছেন তিনি। পুলিশ আটঘাট বেঁধে যে তদন্ত করছে তাতে নানাভাবে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে।
প্রশ্ন উঠছে—হত্যার পর সন্দেহের বশে বিএনপি-জামায়াতের ১১০জনসহ গ্রেপ্তার হওয়া ১৫৫ নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের কী হবে? গতকাল সোমবার পর্যন্ত তাঁরা কারাগারেই বন্দী ছিলেন।
কাদের খান ২০০৮ সালে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে গাইবান্ধা-১ আসন থেকে নির্বাচিত হন। ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি তাঁর বগুড়ার রহমান নগরের বাসায় নজরবন্দী ছিলেন। ২১ তারিখ বগুড়া ও গাইবান্ধা পুলিশ তাঁকে লিটন খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার করে।
কাদের খানের বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপড়াহাটি ইউনিয়নের পশ্চিম ছাপড়াহাটি খানপাড়া গ্রামে। পেশায় চিকিৎসক। লে. কর্নেল হয়ে তিনি অবসরে যান। বগুড়া থেকে দৈনিক উত্তরের খবর নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন কাদের।
পুলিশ হত্যার এই রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারায় গোটা দেশের মানুষের মতো অবাক লিটনের পরিবারও।
“লিটনের সঙ্গে কাদের খানের কোনো বিরোধের কথা আমরা কখনো শুনিনি। এমনকি ইদানীং তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে বলেও জানি না,” বেনারকে বলেন সাংসদের স্ত্রী খুরশীদ জাহান।
অন্যদিকে লিটনের বোন ফাহমিদা বুলবুল স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রী আমাদের সুবিচার পাওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। পুলিশ আমাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছে। আমরা বলেছি অপরাধী যে-ই হোক না কেন তার সাজা হোক।”
যেভাবে এগিয়েছে তদন্ত
গত ৩১ ডিসেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে নিজ বাড়িতে খুন হওয়ার পরপরই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তদন্ত শুরু হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের তত্ত্বাবধানে গাইবান্ধা জেলা পুলিশ, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি), র্যাব একযোগে কাজ শুরু করে।
তদন্তকারী পুলিশ সদস্যরা জানান, কোনো সম্ভাবনাকেই তাঁরা উড়িয়ে দেননি। শেষ পর্যন্ত পুলিশের চোখে ‘ছিনতাই’ এর মতো একটি ‘সাধারণ’ অপরাধের সূত্র ধরে পাওয়া যায় হত্যার ক্লু। সাংসদ লিটনের খুনের মূল পরিকল্পনাকারী কাদের খানসহ যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন তাঁদের।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহীদুল হক বেনারকে বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ এই হত্যা মামলার তদন্তে সর্বোচ্চ পেশাদারির দেখিয়েছে।
“আমি বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে নিজে এই তদন্ত মনিটর করেছি, যেন কোথাও চুল পরিমাণ ত্রুটি না থাকে। আমরা দ্রুততার সঙ্গে মূল আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয়েছি। তদন্তের একেবারে শেষ পর্যায়ে আছি আমরা,” বলেন শহীদুল হক।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তদন্তের শুরু থেকে পুলিশ কমপক্ষে ১০ হাজার কল লিস্ট ও খুদে বার্তা সংগ্রহ করে। যেসব মুঠোফোনের কললিস্ট ও খুদে বার্তা পর্যালোচনা করা হয় সেগুলোর মধ্যে একটি মুঠোফোন ছিল খোয়া যাওয়া।
পুলিশের ভাষ্যমতে, ঘটনাটি ঘটে লিটন হত্যার ঠিক এক মাস আগে। ছিনতাইকারী ছিল তিনজন রানা, মেহেদী ও শাহিন। একটি মুঠোফোন ছিনতাইয়ের পর তারা ঘটনাস্থলে ফেলে যায় গুলি ভর্তি ম্যাগাজিন। এই গুলি কোন অস্ত্রের তা খুঁজে দেখা যায়, এই গুলি শুধু আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তা ব্যবহার করতে পারেন।
এদিকে মুঠোফোনটিও উদ্ধার হয়। এরপর পুলিশ তিন ছিনতাইকারীকে অনুসরণ করতে শুরু করে, যার মূলত হত্যাকারী।
এই তদন্ত চলার মধ্যেই জামায়াত-শিবিরের ১২৩ ও বিএনপির ৩০ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে, কিংবা অস্ত্র-বিস্ফোরক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
ফোনে আড়ি পাতার সপ্তাহ খানিকের মধ্যেই পুলিশ বুঝতে পারে কাদের খানের সঙ্গে ওই তিন ছিনতাইকারীর কথাবার্তা হচ্ছে। এক পর্যায়ে কাদের খান ছিনতাইকারীদের নতুন টোপ দেন। এবার তাঁর লক্ষ্য শামীম হায়দার পাটোয়ারি নামে আরেক রাজনীতিককে খুন করা। কিন্তু ওই তিনজন আর রাজি হচ্ছিল না।
এদিকে গাইবান্ধা-১ আসনের উপনির্বাচন উপলক্ষে পুলিশ বৈধ অস্ত্র জমা নিতে শুরু করে। কাদের খান তাঁর অস্ত্রটিও জমা দেন। কিন্তু অস্ত্রের বিপরীতে ৫০টি গুলি ইস্যু করা হলেও, হদিস নেই ৪০ টির। ছিনতাইয়ের সময় ঘটনাস্থলে ফেলে যাওয়া গুলিভর্তি ম্যাগাজিনটি কাদের খানের বলে প্রমাণ পায় পুলিশ।
গত ফেব্রুয়ারি কাদেরের গাড়িতে করে যাওয়ার পথে সুন্দরগঞ্জ থেকে দুই ছিনতাইকারী মেহেদী হাসান ও শাহিন মিয়া এবং কাদেরের গাড়িচালক হান্নানকে আটক করে পুলিশ। আদালতে ১৬৪ ধারায় তিনজনই জবানবন্দি দেন। খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে তাঁরা।
পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক খন্দকার গোলাম ফারুক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, “কাদের খানের গাড়িচালক আবদুল হান্নান, বাড়ির কেয়ারটেকার শাহিন মিয়া ও মেহেদী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই কাদের খানকে গ্রেপ্তার করা হয়,” গোলাম ফারুক বলেন।
গাইবান্ধার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম মইনুল হাসান ইউসুফের আদালতে আসামিরা জবানবন্দি দেন। তাঁরা বলেন, মে মাসের দিকে কাদের খান তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বলেন, তিনি সাংসদ হতে চান। লিটনকে সরিয়ে দিলে তাঁর ইচ্ছা পূরণ হয়। কথা মতো কাজ সারতে পারলে কাদের খান তাঁদের একটি পেট্রল পাম্প করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
শাহীনকে উদ্ধৃত করে আদালত ও পুলিশ সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের দিন তাঁরা গাইবান্ধা শহরে ছিলেন। সাংবাদিক চন্দন সরকার কাদের খানকে লিটনের অবস্থান নিশ্চিত করেন। এরপর একটি মোটরসাইকেলে করে তাঁরা লিটনের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে হত্যা করেন।
গ্রেপ্তারকৃতদের কী হবে?
লিটন খুন হওয়ার পরপরই বিএনপি-জামায়াতের ১১০ জনসহ মোট ১৫৫ জনকে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তদন্তের এই পর্যায়ে এসে তাদের কী হবে?
জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক শহীদুল হক বলেন, পুলিশ সব ধরনের অভিযোগ খতিয়ে দেখেছে। সে কারণেই গ্রেপ্তার করা হয় তাঁদের।
“৫৪ ধারায় যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাঁরা দ্রুতই ছাড়া পাবেন। তাঁদের বিরুদ্ধে নির্বাচনের সময় অগ্নিসংযোগের অভিযোগ ছিল। পরিবারেরও অভিযোগ ছিল। এখন স্বাভাবিক বিচারপ্রক্রিয়ায় তাঁরা ছাড়া পেয়ে যাবেন,” জানান শহীদুল হক।