নারায়ণগঞ্জে সাত খুন: নূর হোসেন-তারেক সাঈদসহ ১৫ আসামির ফাঁসি বহাল

নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন এবং র‌্যাব–১১ এর সাবেক অধিনায়ক (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন বাংলাদেশের উচ্চ আদালত।

এর আগে নিম্ন আদালতের রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। হাইকোর্টের রায়ে বাকি ১১ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। অনাদায়ে আরও দুই বছর করে কারা ভোগ করতে হবে।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের ওপর এ রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছে, যদি তারা ছাড়া পেয়ে যায়, তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে।

এই মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত ৩৫ আসামির ২৫ জনই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত জানায়, “র‌্যাব সিম্বল অব সিকিউরিটি। কতিপয় সদস্যের কারণে গোটা বাহিনীকে দায়ী করা যায় না।”

সাবেক সেনা কর্মকর্তা (অবসরপ্রাপ্ত ) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “আমি মনে করি না এই ঘটনায় সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। তবে বাহিনীগুলোর জন্য এটা ‘ওয়েক-আপ কল’। তাদের উচিত এ ধরনের অপরাধ-প্রবণ কর্মকর্তা-কর্মচারিদের খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়া।

“রায়ের শাস্তির মাধ্যমে বাহিনীগুলোর সদস্যদের বার্তা দেওয়া হলো যে অপরাধ করে কেউ ছাড় পাবে না,” বলেন তিনি।

“এই রায় দৃষ্টান্তমূলক। আমরা স্বস্তি পেয়েছি। সাজা কমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১১ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখতে আপিলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর,” তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

মামলার বাদী নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, “ন্যায়বিচার পেয়েছি। উচিত সাজা হয়েছে। আশা করি সুপ্রিম কোর্টেও এই রায় বহাল থাকবে এবং দ্রুত কার্যকর হবে।”

নিহত তাজুল ইসলামের ভাই মো. রাজু বেনারকে বলেন, “ছেলেকে ফিরে না পেলেও এই বিচারে আমার শয্যাশায়ী মা অন্তত কিছুটা স্বস্তি পাবেন।”

তবে ১১জনের মৃত্যুদণ্ড কমায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন কাউন্সিলর নজরুলের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যান। তিনি বেনারকে বলেন, “এরা যে অন্যায় করেছে, তার জন্য মৃত্যুদণ্ড উপযুক্ত শাস্তি। আশা করি আপিল বিভাগে নিম্ন আদালতের রায়ই বহাল থাকবে।”

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নূর হোসেনের ভাই নূর উদ্দীন অবশ্য বলেন, “আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। সুপ্রিম কোর্টে যাব। পুরো ঘটনা ঘটিয়েছে সামরিক বাহিনী। আমার ভাই বেসামরিক লোক। তাঁকে অন্যায়ভাবে জড়ানো হয়েছে।”

আদালতে র‌্যাবের সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদের বাবা কর্নেল (অব.) মজিবুর রহমান আদালতে উপস্থিত থাকলেও কোনো কথা বলেননি।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে গণমাধ্যমের সামনে ‘জয়সূচক' চিহ্ন দেখান মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম। আগস্ট ২২, ২০১৭
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে গণমাধ্যমের সামনে ‘জয়সূচক’ চিহ্ন দেখান মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম। আগস্ট ২২, ২০১৭ (ফোকাস বাংলা)

সাত খুনের ঘটনা

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। এর তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ছয়জন ও একদিন পর আরও একজনের লাশ ভেসে ওঠে।

নিহতরা হলেন; নজরুল ইসলাম, তাঁর বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম। সাতজনই নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে ফিরছিলেন।

ঘটনার একদিন পর কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বাদী হয়ে নূর হোসেনসহ ছয় জনের নাম উল্লেখ করে ফতুল্লা মডেল থানায় অপহরণের মামলা করেন। অপহৃতদের মৃতদেহ শীতলক্ষা নদী থেকে উদ্ধারের পর, এই মামলাটিই হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। সাত খুনের ঘটনায় আলাদা আরেকটি মামলা করেন চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা ও র‌্যাব–১১ এর অধিনায়ক তারেক সাঈদ এবং নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহচর নূর হোসেনের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সামনে আসার পরই এই রায়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়।

ন্যায় বিচারের দাবিতে স্থানীয় জনগণ, আইনজীবীরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে সেসব সংবাদ প্রচার করা হয়।

আসামি গ্রেপ্তারে উদ্যোগ নিতে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, সদস্য মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ও চন্দনের জামাতা বিজয় কুমার পাল। রিট আবেদনে হাই কোর্ট তিন র‌্যাব কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়।

সাখাওয়াত হোসেন বেনারকে বলেন, “এই ঘটনাটাকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। তবে নারায়ণগঞ্জের মানুষ সচেতন ছিলেন। আইনজীবীরা সোচ্চার ছিলেন। গণমাধ্যম সহযোগিতা করেছে। উচ্চ আদালত সুবিচার করেছেন। সব শঙ্কার অবসান হয়েছে এই রায়ে।”

গত বছর ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা তারেক সাঈদসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয় আদালত। বাকি নয় আসামির সবাইকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এই মামলার রায়ের পেপারবুক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তৈরির নির্দেশ দেন।

সেবছর ২২ মে থেকে এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শুরু হয়। চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত নুর হোসেনসহ আসামিদের নিয়মিত ও জেল আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে হাইকোর্ট। গত ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি নূর হোসেন, তারেক সাঈদসহ আসামিরা খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেন।

সাজাপ্রাপ্ত আসামি যারা

নূর হোসেন, তারেক সাঈদ ও আরিফ হোসেন বাদে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামিরা হলেন লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, এ বি মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহি আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলিম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন ও সৈনিক তাজুল ইসলাম।

যাবজ্জীবন পাওয়া আসামিরা হলেন; সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর, সার্জেন্ট এনামুল কবির, নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান, রহম আলী, আবুল বাশার, মোর্তুজা জামান, সেলিম, সানাউল্লাহ, শাহজাহান ও জামালউদ্দিন। এছাড়া নয়জন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদের নিম্ন আদালতের দেওয়া কারাদণ্ডের আদেশ বহাল রেখেছে হাই কোর্ট।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি