বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও তিক্ত হওয়ার আশঙ্কা বিশ্লেষকদের

ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব, আগরতলা থেকে ভিসা সেবা বন্ধ করেছে বাংলাদেশ।
কামরান রেজা চৌধুরী
2024.12.03
ঢাকা
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও তিক্ত  হওয়ার আশঙ্কা বিশ্লেষকদের ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ। ২ ডিসেম্বর ২০২৪
সনি রামানী/ বেনারনিউজ

বাংলাদেশ ও ভারতের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের বাকযুদ্ধ ক্রমান্বয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে। গত প্রায় দেড় যুগে এমন বৈরি পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি নিকটতম দুই প্রতিবেশি দেশের মানুষ। 

চিকিৎসা সেবা ও সীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ থেকে শুরু করে দুই দেশে পতাকা পোড়ানো বা পদদলিত করা, বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতি, ভিসা বন্ধ বা সীমিত করা এমনকি দূতাবাসে হামলার মতো ঘটনাগুলো সাম্প্রতিক অস্থিরতা ছড়াতে ভূমিকা রেখেছে। 

এসব অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি হলেও অচিরেই সেই সম্ভাবনা দেখছেন না দুই দেশের কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। বরং দুই দেশের সম্পর্ক আরও তিক্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা তাঁদের। 

তবে মঙ্গলবার ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা সাংবাদিকদের বলেন, “ভারত–বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমুখী, এখানে কথা বলার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। এই সম্পর্ককে শুধু একটি মাত্র বিষয়ে সীমাবদ্ধ করা যায় না।” 

এর আগে আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে সোমবার হামলার প্রতিবাদ জানাতে প্রণয় ভার্মাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। তলবে হাজির শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি আরো বলেন, “আমরা সত্যিকার অর্থে একটি গঠনমূলক ও স্থিতিশীল সম্পর্ক চাই।”

03 BD-IN-protest2.jpeg
ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। ৩ ডিসেম্বর ২০২৪ [মেহেদী রানা/বেনারনিউজ]
 

এদিকে নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে সব ধরণের ভিসা ও কনস্যুলার সেবা মঙ্গলবার থেকে বন্ধ ঘোষণা করেছে আগরতলার বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন।

তবে এ ঘটনায় ত্রিপুরায় মঙ্গলবার সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, চার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েছে ভারত সরকার।

এর আগে আগরতলার ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ উল্লেখ করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, কূটনৈতিক ও কনস্যুলার সম্পত্তি কোনো অবস্থায় লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। 

সাম্প্রতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “ভারত আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশি, তাদের সাথে আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক চাই। তবে সেটির ভিত্তি হতে হবে নায্যতা ও সমতা এবং মর্যাদাপূর্ণ।” 

“আশা করি, ভারত সরকার বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশাকে অনুধাবন করে একটি বন্ধুসুলভ ও দায়িত্ববান প্রতিবেশি হিসেবে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করবে,” বলেন প্রেস সচিব। 

দীর্ঘ দেড় দশকের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে তিক্ত হয়ে উঠেছে। সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে সম্প্রতি গ্রেপ্তারের ঘটনায় যা সহিংস হয়ে ওঠে। 

জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় কারাগারে পাঠানো চিন্ময়ের পক্ষে মঙ্গলবার কোনো আইনজীবী ছিলেন না। তাই চট্টগ্রামের আদালত জামিন শুনানি পিছিয়ে ২ জানুয়ারি পরবর্তী দিন ধার্য করেছে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “সরকারকে চাপে রাখতে চিন্ময় দাসের নেতৃত্বে হিন্দুসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন ও আক্রমণের বিষয়টি ভারত সরকার ব্যবহার করবে।” 

“গত তিন মাস ধরে প্রতিদিন যেভাবে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটছে তাতে মনে হয় না সহসাই বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে। সামনের দিনগুলোতে সম্পর্ক আরও খারাপ হবে বলেই মনে হচ্ছে,” বলেন তিনি। 

এর কারণ ব্যাখ্যা করে নিজাম উদ্দিন বলেন, “ভারতের সকল রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ প্রশ্নে আওয়ামী লীগের পক্ষে। গত ১৫ বছর ভারতের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত নানা স্বার্থ রক্ষা করেছে শেখ হাসিনা সরকার।” 

“অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং বিএনপিসহ যেসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে এগিয়ে তারা কেউই ভারতের সাথে রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত নয়। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত-বিরোধিতা আগেও ছিল, এখন তা বরং বেড়েছে, যা আমাদের জন্য ভালো হবে না,” বলেন অধ্যাপক নিজাম। 

“ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশি এবং বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ। আমরা তাদের ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল। অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার ভারতবিরোধী বক্তব্য দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটাচ্ছে,” মনে করেন তিনি। 

লাভবান হবে ধর্মভিত্তিক দলগুলো

বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে বড় ভূমিকা রাখছে দুই দেশের ধর্মভিত্তিক দলগুলো। এর ফলে চাপে পড়বে দুই দেশের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বেনারকে বলেন, “গত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো তুলনামূলক ভালো করেছে। ধারণা করা হয়, আগামী নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতায় আসা অনেক কঠিন হবে।” 

“এই অবস্থায় বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন করা হচ্ছে, এমন প্রচার চললে ভারতের জনগণকে আরও বেশি মুসলিমবিদ্বেষী করা যাবে এবং এতে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে বিজেপি। তারা আগামী নির্বাচন পর্যন্ত এই ইস্যুটি জিইয়ে রাখতে চাইবে,” মনে করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ। 

তিনি বলেন, “একইভাবে ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন সম্পর্কে ভূয়া ও অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ করলে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা আরও বৃদ্ধি পাবে। এতে সুবিধা পাবে ধর্মভিত্তিক দলগুলো। এতে ক্ষতি হবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের।” 

ড. ইমতিয়াজ বলেন, “বাংলাদেশে ঢালাওভাবে ভারত-বিরোধিতা চলতে থাকলে সমাজে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হবে। হিন্দুদের প্রতি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আরও নেতিবাচক হতে থাকবে, যা বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে না।” 

ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যের নিরাপত্তা এবং কৌশলগত কারণে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী শক্তিকে ক্ষমতায় দিল্লি দেখতে চাইবে না বলেও মনে করেন তিনি। 

তবে বিভিন্ন ইস্যুকে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এই দুই দেশের কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে যুক্ত থাকা অনিবার্য বলে মনে করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ। 

তিনি বলেন, “ভারত একটি বড় দেশ। বিশ্বে তার প্রভাব রয়েছে। সুতরাং, হিন্দুদের ওপর আক্রমণের বিষয়টি কেবল অস্বীকার করে অথবা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ না বলে সেটির সুরাহা করা দরকার।” 

দিল্লিভিত্তিক শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠান মনোহর পারিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যাণ্ড অ্যানালাইসেস’র গবেষক ড. এস. শ্রুতি পাটনায়েক বেনারকে বলেন, আগরতলায় সহকারী হাইকমিশনে আক্রমণের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। 

“বাংলাদেশে একটি গণঅভ্যূত্থান হয়েছে। অনেকের মধ্যে কিছুটা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। কিছুদিন পর এটি থাকবে না। সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে,” মনে করেন তিনি। 

ড. শ্রুতি বলেন, “বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্কের ভিত্তিতে। এখানে বাংলাদেশিরা বেড়াতে আসেন, চিকিৎসার জন্য আসেন। এর কারণ ভারতের হাসপাতাল স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। যারা ভারত যাব না বলছেন, তারা তো সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক যাবেন।” 

‘ভারতকে মনে রাখতে হবে এটি শেখ হাসিনার বাংলাদেশ নয়’-সম্প্রতি আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের এমন বক্তব্যের উদাহরণ টেনে ড. শ্রুতি বলেন, “এগুলো কোনও ভালো কথা নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্নভাবে নানা কথা লেখা হচ্ছে। এগুলোকে আমলে নেওয়া যাবে না।” 

“দুই দেশের নেতাদের উচিত আলোচনার মাধ্যমে কীভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়, সেই পথ খুঁজে বের করা,” বলেন ড. শ্রুতি। 

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি 

গণঅভ্যূত্থানের মুখে ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ ও নিপীড়নের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে সেগুলোকে গুজব, মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত হিসাবে উল্লেখ করে।

03 BD-IN-protest3.jpeg
ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ। ২ ডিসেম্বর ২০২৪। [সনি রামানী/ বেনারনিউজ]

২৮ নভেম্বর কলকাতা সহকারী দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভে প্রধান ‍উপদেষ্টা ইউনূসের কুশপুত্তলিকা এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পোড়ানো হয়। 

২ ডিসেম্বর হিন্দু উগ্রগোষ্ঠী আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন কার্যালয় ভাঙচুর করে। জাতীয় পতাকায় আগুন দেয়। 

এর প্রতিবাদে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেঝেতে ভারতের পতাকা এঁকে তার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া হয়। 

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী হিন্দুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করতে জাতিসংঘের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।

এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান নিয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

বৈঠক শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ভারত আওয়ামী লীগের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখে।

এ ছাড়া বুধবার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা এবং পরদিন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করবেন বলে জানায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।