অপারেশন ক্লিন হার্টের দায়মুক্তি অবৈধ, মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ভুক্তভোগী

ঢাকা থেকে পুলক ঘটক
2017.01.04
অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় এভাবে নাগরিকদের চোখ বেঁধে গ্রেপ্তার করা হয়। অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় এভাবে নাগরিকদের চোখ বেঁধে গ্রেপ্তার করা হয়। ফাইল ফটো।
ফিরোজ চৌধুরী

সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ১৪ বছর আগে পরিচালিত যৌথ অভিযানে জড়িতদের দায়মুক্তির বিধানকে বেআইনি ঘোষণা করে গত ২ জানুয়ারি পুর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হবার পর ভুক্তভোগিরা কেউ কেউ ক্ষতিপূরণ ও প্রতিকার চেয়ে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরীসহ পদস্থ কয়েকজন সেনা, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সাবেক বা বর্তমান কর্মকর্তা মামলায় আসামী হতে পারেন। একইসঙ্গে আসতে পারে ওই সময়ে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের নামও।

আইনজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এমন মামলা দায়ের করার উদ্যোগ একেবারেই বিরল। র‍্যাব–পুলিশ হেফাজতে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘এনকাউন্টার’ এর নামে প্রায়ই নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও এসবের প্রতিকার চেয়ে আদালতে যাওয়ার নজির তেমন নেই।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে যৌথবাহিনীর ওই অভিযান চলে। তখন সরকার প্রধান ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর হাসান মশহুদ যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং এখনও দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।

নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ অভিযানে অন্তত ৬০ জন গ্রেপ্তার অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তবে সরকার সে সময় ১২ জন নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করে। প্রতিটি মৃত্যুর পর যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘হার্ট অ্যাটাকে’ আসামীর মৃত্যু হয়েছে।

তবে রিট মামলায় বাদী পক্ষের জমা দেওয়া নথি থেকে ৫৭ জন ব্যক্তি নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে যৌথ বাহিনীর নির্যাতনে আরও বহু সংখ্যক মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন বলে আদালতকে জানানো হয়।

অপারেশন ক্লিন হার্ট অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন, ২০০৩’ করা হয়। এই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী জেড আই খান পান্না ২০১২ সালে রিট আবেদন করেন।

২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাই কোর্ট বেঞ্চ দায়মুক্তি প্রদান আইনটি অসাংবিধানিক ও বেআইনি ঘোষণা করে।

দায়মুক্তি আইনে বলা হয়েছিল, অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ কোনো আদালতে প্রতিকার চাইতে পারবেন না। কারও বিরুদ্ধে মামলা বা বিচার প্রার্থনা করা যাবে না।

তবে হাইকোর্টের রায়ের ফলে ওই আইনটি বাতিল হওয়ায় এখন যে কেউ প্রতিকার চেয়ে মামলা করতে পারেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন মামলার বাদী জেড আই খান পান্না।

ওই আইনজীবী আরও বলেছেন, “যৌথবাহিনীর ওই অভিযানে ভুক্তভোগীরা মামলা করা ছাড়াও সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবেন।”

রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করা আইনজীবী শাহদীন মালিক রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, দায়মুক্তি দিয়ে যৌথবাহিনীকে আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছিল। সেই আইনটি উচ্চ আদালত বাতিল করেছে।

এদিকে আদালত বলেছেন, যতবড় অপরাধী হোক না কেন, পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ হচ্ছে তাকে গ্রেপ্তার করে তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদ করা। এর বাইরে কাজ করার ক্ষমতা সংবিধান বা আইন কাউকে দেয়নি।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বেনারকে বলেন, “আদালতের রায় রাষ্ট্রপক্ষ মেনে নিতে পারে। আবার আপিল বিভাগের এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনও করতে পারে। এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”

এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, “ওই অপারেশন ন্যায়সংগত ছিল না।”

চলছে মামলার প্রস্তুতি

খালেদা জিয়া ও হাসান মশহুদসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন অপারেশন ক্লিন হার্টে নির্যাতিত সাংবাদিক বরুণ ভৌমিক নয়ন। বেনার নিউজকে তিনি জানিয়েছেন, ২০০২ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর চোখ বেঁধে নির্যাতন করে। জেলে পাঠানোর আগে তাঁর হাতে অস্ত্র তুলে মামলা দেওয়া হয়।

“জেলে যাওয়ার কয়েকদিন পর আমাকে আবারো রিমান্ডে নেওয়া হয় এবং ১০ দিন ধরে আমাকে নিয়মিতভাবে মারধর করা হয়েছে,” জানান বরুণ।

তিনি জানান, “আমার পায়ে পচন ধরে এবং ডাক্তাররা পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন৷ ভাগ্যক্রমে তা করতে হয়নি৷ আমি শরীর ও মনে সেই নির্যাতনের চিহ্ন এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি।”

“আদালত যেহেতু ঐ আইনটি বাতিল করে দিয়েছে, সুতরাং আমি মামলা করব। আমি খালেদা জিয়াকে প্রধান আসামী করব। কারণ তাঁর নির্দেশেই অবৈধ অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। তৎকালীন সেনা প্রধান হাসান মশহুদকে করব দ্বিতীয় আসামী।”

এ বিষয়ে বেনার নিউজের সঙ্গে কথা হয়েছে দেশের নেতৃস্থানীয় সংস্কৃতি কর্মী ও আবৃত্তিকার আহকাম উল্লাহর সঙ্গে। তিনি সে সময় গ্রেপ্তার ও নির্যাতিত হয়েছিলেন। তবে তিনি মামলা করতে আগ্রহী নন।

আহকাম উল্লাহ বলেন, “একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অপারেশন ক্লিনহার্ট পরিচালনা করা হয়েছিল। এই অভিযানে রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ অসংখ্য মানুষকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন চালানো হয়। যারা এটা করেছিল তারা ইতোমধ্যে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে। এর মধ্যেই আমি প্রতিকার পেয়েছি।”

বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং বেসরকারী আবাসন মালিকদের সংগঠন রিহ্যাবের সহসভাপতি আহকাম উল্লাহকে গ্রেপ্তার করে এক মাস জেলে রাখা হয়েছিল।

কথা হয় অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় নিহত এক ব্যক্তির ভাইয়ের সঙ্গে, যিনি আরও বিপদের আশঙ্কায় মামলা করতে চান না।

মানবাধিকার কর্মী জেড আই খান পান্না বলেন, “এই রায়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা প্রচলিত আইনে ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারবে অথবা ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করতে পারবে৷ তবে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা করার মতো সাহসী লোকেরও অভাব আছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।