বাংলাদেশের ‘ভঙ্গুর’ পুলিশকে দায়িত্বে ফেরাতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার পরামর্শ

জিয়া চৌধুরী
2024.12.14
ঢাকা
বাংলাদেশের ‘ভঙ্গুর’ পুলিশকে দায়িত্বে ফেরাতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার পরামর্শ বগুড়ায় বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করছে। ৪ আগস্ট, ২০২৪।
এএফপি

বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তা আমিন (ছদ্মনাম) গত কয়েক মাস ধরে খুব কম সময়ই ঠিকভাবে ঘুমাতে পেরেছেন।  ঘুমের ওষুধ খেয়ে চেষ্টা করলেও কয়েক ঘন্টার বেশি ঘুমাতে পারছেন না, বরং ঘুমের মধ্যেই দুঃস্বপ্নে আঁতকে জেগে উঠছেন।

“আমি স্বপ্নেও গুলির শব্দ শুনছি।  এমন দুঃস্বপ্ন আমাকে প্রতিরাতে তাড়া করছে,” আমিন, পরিচয় না প্রকাশ করার শর্তে বেনারকে তার গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতার কথা বলেন।

পুলিশ কনস্টেবল মোহাম্মদও (ছদ্মনাম) একই কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করছেন। “ডিউটিতে বের হলেই ফুটওভারব্রিজের ওপর থেকে ঝুলে থাকা সহকর্মীদের লাশের ছবি আমাকে তাড়া করে ফিরছে,” নিরাপত্তাজনিত কারণে নিজের পরিচয় গোপন রেখে জানান তিনি। 

''এমনকি চা খেতে বাসা থেকে বের হলেও অনেক মানুষের ভিড়ে অজানা ভয় কাজ করে,” বেনারকে বলেন মোহাম্মদ।  “আমি জানি না কিভাবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মিলবে।”

গত জুলাই-আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গণবিক্ষোভের পর বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা কিভাবে 'ট্রমা'র মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছেন তা 'আমিন' ও  'মোহাম্মদ'-এর অভিজ্ঞতা থেকে খানিকটা আঁচ করা যায়।

বিক্ষোভে সহিংসতায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্যসহ ১৪০০ জনেরও বেশি লোক মারা যান এবং আরও কয়েক হাজার আহত হন।  ছাত্র-জনতা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ওই সময়ের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সহযোগীদের দায়ী করে বিচার দাবি করছে।

৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ২ লাখ ১৪ হাজার সদস্যের পুলিশ বাহিনী অনেকে আবারো আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে, ট্রমা ও হতাশায় ডিউটিতে 'ইনঅ্যাকটিভ' থাকছেন। 

“ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এতোগুলো মানুষ মারা যাওয়ার পর পুলিশ সদস্যরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।  তাদের সহকর্মীরাও মারা গেছেন।  এমন অবস্থা থেকে বের হতে সব কিছুর আগে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে,” বেনারকে বলেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযু্ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বেনারকে বলেছেন, এতো বড় একটা গণবিক্ষোভে পুলিশের নেতিবাচক ও নিষ্ঠুর ভূমিকায় অনেক পুলিশ সদস্য 'মোরালি উইক' হয়ে পড়েছেন, সেই 'ট্রমা' থেকে অনেকে এখনো বের হতে পারেননি।

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব পলাশ বলেছেন, বিপর্যয়ের পর পুলিশের মধ্যে ট্রমা এখনো পুরোপুরি কাটেনি।  তবে অনেকটা উন্নতি হয়েছে।  এখন পুলিশের মনোবল চাঙা করতে আরও দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

8d45fc37-bf33-48a8-a342-ab964057722a.jpeg
ঢাকার রামপুরা এলাকায় সংঘর্ষের সময় জনতা একজন পুলিশ অফিসারকে মারধর করে। ১৮ জুলাই, ২০২৪ । [মোহাম্মদ পনির হোসেন/রয়টার্স]

'ট্রমা'র মধ্যে বসবাস

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবার আগে ট্রমায় থাকা পুলিশ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিউটের অধ্যাপক ড. হেলালউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “কোনো পুলিশ সদস্য যদি মানুষের কাছে যেতে ভয় পান বা মানুষের কাছে না যেতে পারেন, তাহলে তিনি সেবা দেবেন কীভাবে? তাই তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে, অনেককে জরুরি ভিত্তিতে কাউন্সেলিং করানো দরকার।”

পুলিশ কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সরকারের উচিত পুলিশ সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া।

ড. ওমর ফারুক বলেন, আত্মবিশ্বাস ফেরাতে ও পুলিশ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে দ্রুত উদ্যোগ জরুরি।  

“আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর এটা স্পষ্ট যে পুলিশের আচরণগত পরিবর্তন আনা জরুরি। পাশাপাশি জনগণের সাথে যে বিশ্বাসের ঘাটতি, তা পূরণ করতে হবে।  এ জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে তারা ট্রমা থেকে বের হতে পারবে।”

পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বৃহস্পতিবার বেনারনিউজকে বলেছেন, পুলিশ সদস্যদের মনোবল ফেরাতে ও ভঙ্গুর অবস্থা থেকে উত্তরণে তিনি জেলায় জেলায় যাবেন।

‘‘তাদের কথা শুনতে হবে, তারা ট্রমার মধ্যে আছেন কি না, তাদের সাইকোলজিক্যাল রিহ্যাবিলিটেশন অথবা দীর্ঘমেয়াদী ছুটি প্রয়োজন কি না, সেসব বিষয় সহানুভূতির সঙ্গে দেখতে হবে।”

“হয়তো পরিবারের সাথে বেশ কিছুদিন সময় কাটালে অনেকের পক্ষে স্বাভাবিক কাজে ফেরা সহজ হবে।  এজন্য আমরা তাদের কাছে যেতে চাই, তাদের সমস্যাগুলো শুনতে চাই।”

এমন পরিস্থিতি উত্তরণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থাগুলোর সহায়তা চাইবেন বলেও জানান আইজিপি।

তাঁর মতে, আস্থার সংকট থাকায় পুলিশের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে সময় লাগবে।

পুলিশের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটের পর পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা ফেরাতে জন্য বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রমও বাস্তবায়ন করতে হবে।

3363b8ed-aa4e-4d0d-a18e-005d85650f53.jpeg
নবনিযুক্ত পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে ঢাকায় বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন। [ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তর]

পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার না কবার পরামর্শ

দুই লক্ষাধিক সদস্যের বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর মনোবল ভেঙে যাওয়ার ফলে তাদের বড় অংশই স্বাভাবিক দায়িত্বে ফিরতে পারছে না।  শেখ হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার হয়ে দেড় যুগে এই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেআইনি কাজে অসংখ্য রেকর্ড সৃষ্টি করে ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়েছে।  ভবিষ্যতে পুলিশ এমন পরিস্থিতিতে যাতে না পড়ে সেজন্য সংস্কার প্রকল্পে রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশের ব্যবহার বন্ধের ওপর জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট সবপক্ষ।

সাবেক পুলিশ প্রধান মুহাম্মদ নুরুল হুদা বেনারকে বলেন, পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে বিগত বছরগুলোতে জনগণের সঙ্গে দুরত্ব বেড়েছে।

পুলিশ সংস্কার নিয়ে জনগণের প্রত্যাশা জানতে চেয়ে একটি জরিপ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত ৪ ডিসেম্বর জরিপের প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, প্রতি দশ জনে নয়জনই (৮৯.৫ শতাংশ) চায় পুলিশ রাজনৈতিকভাবে আর ব্যবহার না হোক।

“আমি আশা করি পুলিশ সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে।  পুলিশ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার না হলে পুলিশ সদস্যদের মনোবল ফিরে আসবে, জনগণের সঙ্গেও দূরত্ব কমবে,” বলেন নুরুল হুদা।

সৃশৃঙ্খল পুলিশ বাহিনীর এই পরিণতির জন্য রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশকে অপব্যবহার করাকে অন্যতম কারণ বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

ড. ওমর ফারুক বলেন, “যথাযথ আইন অনুসরণ করে রাজনৈতিক শক্তির বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রীয় কাজে শুধু জনগণের সেবায় নিয়োজিত রাখতে হবে পুলিশকে।”

পুলিশ প্রশাসনে সংস্কারের লক্ষ্যে গত সেপ্টেম্বরে অন্তবর্তী সরকার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেন সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব সফর রাজ হোসেনকে।  এসব বিষয়ে তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি আপাতত কোন মন্তব্য করতে চাননি। 

19e94fb9-cdca-418f-b039-e0a61ee03014.jpeg
ঢাকায় একটি সমাবেশে বাংলাদেশের র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছে। ১০ ডিসেম্বর, ২০২২, [মাহমুদ হোসেন অপু/এপি]

র‍্যাব বিলুপ্তির দাবি

এদিকে, গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানকে (র‍্যাব) বিলুপ্ত করার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।  শেখ হাসিনার শাসনামলে পুলিশের এই বিশেষ বাহিনী যেখানে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও কাজ করেন, তাদের দিয়ে বেশিরভাগ গুম-খুন ও বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড করানো হয়েছে বলে জোর অভিযোগ আছে।

২০০৪ সালের মার্চ মাসে বিএনপির শাসনামলে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে র‍্যাব গঠন করা হয়।  অপরাধীদের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও গুরুতর তদন্ত কাজে সহযোগিতা করথে এই বাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়।

এই বাহিনীকে সংস্কার না করে কেন বিলুপ্ত করতে চায়, প্রশ্ন করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমদ বেনারকে বলেন, এটা মেডিকেল বিদ্যাতেও আছে, যখন একেবারে গ্যাংরিন হয়ে নষ্ট হয়ে যায়, তখন কেটে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

হাফিজ বলেন, ‘‘আমরা মনে করেছি, র‍্যাব আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হয়েছে, দেশে র‍্যাব মানেই একটা দানব।  তারা খুন-গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িত থাকায় এটিকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছি।’’

প্রায় ১৫ হাজার সদস্যের র‍্যাব বিলুপ্তির বিষয়ে বিএনপির প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার বেনার নিউজের এক প্রশ্নের জবাবে বাহিনীর মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে সরকার যা সিদ্ধান্ত নেবে, তাই মেনে নেওয়া হবে।  তার মতে, র‍্যাবের বিরুদ্ধে গুম খুনের কিছু অভিযোগ আছে, সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমেই এই দায় মুক্ত হওয়া সম্ভব।

বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় র‍্যাবের অতীত অপরাধের জন্য নির্যাতিত ব্যক্তি ও হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারের কাছে ক্ষমা চান সংস্থাটির প্রধান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।