গায়েবি মামলার রিটে হাইকোর্টের দ্বৈত আদেশ
2018.10.09
ঢাকা
![181009_Fictitious_cases_1000.JPG 181009_Fictitious_cases_1000.JPG](https://www.benarnews.org/bengali/news/politics-10092018153315.html/181009_Fictitious_cases_1000.JPG/@@images/257abd37-6b6d-42d5-b9fb-55e014b57f93.jpeg)
বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া কথিত ‘গায়েবি’ মামলার প্রতিকার চেয়ে রিট মামলার শুনানি শেষে মঙ্গলবার দ্বিধাবিভক্ত আদেশ দিয়েছে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ।
“যেহেতু দুই জন বিচারক দুই রকম আদেশ দিয়েছেন, তাই নিয়ম অনুসারে মামলাটি প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে। তিনি মামলাটির শুনানির জন্য অন্য বেঞ্চ গঠন করে এই মামলা নিষ্পত্তির দায়িত্ব দেবেন,” বেনারকে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
দ্বৈত বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর আদেশে ‘গায়েবি’ মামলা হিসেবে অভিযোগকারীসহ অন্যান্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে করা মামলা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে সরকারের উপর রুল জারি করেন।
অন্যদিকে আদালতের কনিষ্ঠ বিচারপতি আশরাফুল কামাল তাঁর আদেশে বলেন, “রিটটি সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুসারে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই এ রিটটি আমি খারিজ করলাম।”
এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “এগুলো সব ফৌজদারি মামলা। এসব মামলায় ভুল ত্রুটি যাই থাক, সেটা তদন্ত সাপেক্ষ। এগুলো রিটের আওতায় আসতে পারে না। অভিযুক্তরা হাইকোর্টে এসে এসব মামলা কোয়াশিং (বাতিল) চাইতে পারেন। সুতরাং রিট আবেদন খারিজ করাই যথাযথ।”
দ্বিধাবিভক্ত আদেশের কারণে হতাশা প্রকাশ করে মামলার বাদি খ্যাতিমান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “রুল পাওয়ার আশায় আদালতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তা হয়নি।”
গত ২২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় গায়েবি মামলায় নামে কিংবা বেনামে অসংখ্য ব্যক্তিকে আসামি করার কারণ জানতে চেয়ে রিটের আবেদন করা হয়।
একইসঙ্গে, এ বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়। পরবর্তীতে যেন এ ধরনের মামলা দেওয়া না হয়, হাইকোর্টের কাছ থেকে তার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার করে গায়েবি বা আজগুবি মামলা দায়ের করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, রিটে সে বিষয়ে রুল জারির আবেদন রয়েছে।
রিটের পক্ষে শুনানি করেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারল মমতাজ উদ্দিন ফকির, মুরাদ রেজা ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল।
গায়েবি মামলার আকস্মিক ঢল
কয়েকটি ‘গায়েবি’ মামলার বিবরণ দিয়ে বিএনপি’র আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বেনারকে বলেছেন, “২০০৭ সালে মারা গেছেন, কিংবা চলতি বছর হজে ছিলেন, বিদেশে থাকেন- এমন লোকদের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২০ দিনে সারা দেশে বিএনপির জ্যেষ্ঠ আইনজীবীসহ বিভিন্ন নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা চার হাজার মামলায় তিন লাখেরও বেশি লোককে আসামি করা হয়েছে।”
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বেনারকে বলেছেন, “আসন্ন নির্বাচনে আমাদের দলের নেতাকর্মীরা যাতে অংশ নিতে এবং ভোট কেন্দ্রে কোনো এজেন্ট দিতে না পারে তা নিশ্চিত করার জন্য ভৌতিক মামলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের আসামি করা হচ্ছে। সরকার চাচ্ছে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা যাতে পলাতক থাকে এবং নির্বাচনের মাঠে নামলেই তাদের যেন গ্রেফতার করা যায়।”
তবে ক্ষমতাসীন জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদের (একাংশ) কার্যকরী সভাপতি মইন উদ্দিন খান বাদল এত মামলার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বেনারকে বলেন, “যত মামলা ও আসামির কথা শোনা যাচ্ছে সেসবই কাল্পনিক সংখ্যা।”
পুলিশের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন
কথিত গায়েবি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীসহ অনেক মৃত ব্যক্তিকে আসামি করায় পুলিশের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। সোমবার শুনানির শুরুতে কয়েকটি মামলার এজাহার পর্যবেক্ষণ করে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতো ব্যক্তির বিরুদ্ধে এরকম মামলা হলে জনগণের কাছে কী মেসেজ যাবে? এতে পুলিশের ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়।”
জবাবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল আদালতকে বলেন, উনি (খন্দকার মাহবুব হোসেন) তো শুধু আইনজীবীই নন, একটি রাজনৈতিক দলের পদধারী। এ পর্যায়ে আদালত বলেন, “এটা কী বললেন? তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না, এটা তো আইনে নেই। আগে আইনজীবীরাই বেশি রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।”
উল্লেখ্য, প্রবীণ আইনজীবি খন্দকার মাহবুব হোসেন বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান এবং সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি। তাঁকে একই স্থানে সংঘঠিত চারটি ককটেল বিস্ফোরণের মামলায় আসামি দেখানো হয়েছে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে করা এমন অসংখ্য মামলার নজির দেশ জুড়ে দেখা যাচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে।
১৯৯৮ সালের ৩১ জানুয়ারি মারা যাওয়ার ২০ বছর পর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকার বাসিন্দা দাইয়ান মুন্সিকে গত ৭ ফেব্রুয়ারি করা একটি মামলায় আসামি করেছে পুলিশ। দাইয়ানসহ অন্যরা পুলিশের দিকে ঢিল ছুঁড়েছেন, হামলা চালিয়েছেন ও সরকারি কাজে বাধা দিয়েছেন বলে অভিযোগ আনা হয়।
তাঁর বিস্মিত পরিবার জানায়, দাইয়ানের এক ছেলে বিএনপি করে বলেই হয়ত ছেলের সঙ্গে বাবাকেও মামলায় আসামি দেখানো হয়েছে। অথচ আসলেই তিনি অপরাধী কি না এমন কি লোকটি জীবিত না মৃত পুলিশ সেটুকু জানার প্রয়োজন মনে করেনি।
বগুড়ার ধুনটের ৮৬ বছর বয়সী আবদুল খালেক দেড়মাস ধরে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী হলেও তিনি স্থানীয় বিএনপি নেতা–কর্মীদের সঙ্গে নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন অভিযোগে একটি মামলায় তাঁকে আসামি করেছে পুলিশ। অথচ খালেক হাঁটতে পারেন না, এমনকি ঠিকমতো কথাই বলতেই পারেন না।
এর আগে ঢাকা ও যশোরেও মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে গায়েবি অভিযোগে মামলা করে সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশ।
এ ছাড়াও সম্প্রতি সরকার দলীয় নেতা–কর্মীদের করা মামলায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় দায়ের কয়েকটি মামলায় প্রবাসী, হজ্জ পালনে বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিদেরও আসামি করা হয়েছে।
তবে এতকিছুর পরেও পুলিশের জোর দাবি, তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
এদিকে কেউ অপরাধে সম্পৃক্ত না থাকলে তদন্তের মাধ্যমে মামলা থেকে তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হবে বলে সোমবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয় সহায়তা করেছেন জেসমিন পাপড়ি