খালেদার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও নেতাকর্মী গ্রেপ্তারে উত্তপ্ত রাজনীতি

পুলক ঘটক
2017.10.13
ঢাকা
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দেন খালেদা জিয়া। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় হাজিরা দেন খালেদা জিয়া। ১৩ এপ্রিল ২০১৭।
নিউজরুম ফটো

বিদেশে অবস্থানরত বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মাত্র চার দিনের ব্যবধানে পরপর তিনটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় রাজনীতিতে নতুন উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে।

আগামী ১৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে বিএনপির সংলাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এর মাঝে হঠাৎ করে খালেদার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বেশ কিছু নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনাকে রাজনীতির বাঁক পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন অনেকেই।

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রতিবাদে বুধবার ঢাকা মহানগরীসহ সারা দেশে বিক্ষোভ করে বিএনপি। শনিবার আবারও সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বেনারকে বলেন, “সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এটা সরকারের কুটচালের অংশ।”

তিনি বলেন, “প্রধান বিচারপতিকে অসুস্থ দেখিয়ে জোর করে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশের সকল আদালতকে বার্তা দেওয়া হয়েছে যে সরকারের কথা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। আদালতকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিয়ে বিএনপি’র বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে।”

অবশ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বেনারকে বলেন, “এটা পুরোপুরি আদালতের বিষয়। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। খালেদা জিয়া আদালতকে অবজ্ঞা করছেন। মামলায় হাজির হচ্ছেন না। আদালত বিচারিক নিয়মে তাঁর বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করেছেন।”

“একজন নাগরিক হিসেবে তিনি আদালতকে উপেক্ষা করতে পারেন না,” বলেন হানিফ।

তবে এ বিষয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “সম্প্রতি কিছু বিষয়ে আদালত এবং রাজনীতি একাকার হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। সে জন্যই এসব প্রশ্ন উঠছে।”

মানুষ পোড়ানোর মামলা

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গত সোমবার একটি এবং বৃহস্পতিবার দুটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।

বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার মামলায় সোমবার কুমিল্লার জেলা ও দায়রা জজ জেসমিন বেগম বিএনপির চেয়ারপারসনসহ দলটির ৭৮ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রামে একটি বাসে পেট্রলবোমা হামলায় আটজন নিহত হন। আহত হন আরও ২০ জন। ওই মামলায় সম্প্রতি খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করা হয়।

পতাকা অবমাননার মামলা

২০০১ সালে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে মন্ত্রী বানানোর দায়ে এই মামলা দায়ের করেছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক সংগঠন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী।

২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার হাকিম আদালতে দায়েরকৃত মামলার আরজিতে বলা হয়, স্বীকৃত স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে খালেদা জিয়া দেশের মানচিত্র এবং জাতীয় পতাকার ‘মানহানি ঘটিয়েছেন’।

এই মামলায় সমন জারির পরও খালেদা জিয়া আদালতে হাজির না হওয়ায় মহানগর হাকিম নূর নবী বৃহস্পতিবার তাঁকে গ্রেপ্তারের আদেশ দেন।

এতিমখানা দুর্নীতি মামলা

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানিতে হাজির না থাকায় বৃহস্পতিবার খালেদার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ঢাকার পঞ্চম আদালতের জজ মো. আখতারুজ্জামান।

এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল বেনারকে বলেন, “আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আদালত বহুবার সময় দিয়েছেন, শুনানি পিছিয়েছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া আদালতে আসেননি। বারবার সময়ের আবেদন করে মামলা বিলম্বিত করা হচ্ছে।”

তবে খালেদার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেছেন, “লন্ডনে পা ও চোখের ডাক্তার দেখানোর জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকায় তিনি আদালতে আসতে পারেননি। আদালতে সেই কাগজ জমা দিয়ে সময় প্রার্থনা করা হয়েছে। কিন্তু আদালত সময় না দিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।”

খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য গত ১৫ জুলাই লন্ডনে যান। এ মামলার আরেক আসামি খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমানও গত নয় বছর ধরে সেখানে রয়েছেন।

বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানিসহ অন্তত ৩৪টি মামলা রয়েছে৷ এরমধ্যে দুর্নীতির মামলা পাঁচটি৷ মামলাগুলো হচ্ছে- জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা, গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা, বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলা ও নাইকো দুর্নীতি মামলা৷ এই মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছিল ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ে৷ বাকি মামলা দায়ের হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে৷

এই মামলাগুলোর প্রায় সবগুলোতেই তিনি জামিনে ছিলেন।

গ্রেপ্তার আতঙ্ক

গত এক সপ্তাহে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের বেশ কিছু নেতা কর্মীকে গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। সোমবার জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলসহ শীর্ষ পর্যায়ের ৯ জন নেতাকে আটক করা হয়।

মঙ্গলবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এবং এবং চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানের নেতৃত্বে একদল নেতা কর্মী জেহাদ স্কয়ারে ফুল দিতে গেলে এনডিপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মনজুর হোসেন ঈসা এবং ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান আশিকসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

একই দিন চট্টগ্রামে লেবার পার্টির চেয়ারম্যানসহ বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের ৩০ জন নেতা কর্মীকে আটক করা হয়। তবে রাতে লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ইরামকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে দলেটির নেতারা জানিয়েছেন।

এসব তথ্য উল্লেখ করে আমান উল্লাহ আমান বেনারকে বলেছেন, “নির্বাচনের আগে বিএনপি’র নেতা কর্মীরা যাতে মাঠে থাকতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে এসব করা হচ্ছে।”

গ্রেপ্তার এড়াতে দলটির পক্ষ থেকে নেতা কর্মীদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নেতা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।