বাংলাদেশে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকাজ উদ্বোধন এ মাসেই

জেসমিন পাপড়ি
2017.11.10
ঢাকা
এগিয়ে চলছে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যক্রম। এগিয়ে চলছে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কার্যক্রম। ২৫ অক্টোবর ২০১৭।
সৌজন্যে: রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প

বাংলাদেশের বহুল আলোচিত রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূলপর্বের নির্মাণকাজ শুরুর অনুমতি পেয়েছে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন (বিএসই)। এর মধ্য দিয়ে ৩২ তম দেশ হিসেবে বিশ্ব পরমাণু ক্লাবে যুক্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

“বাংলাদেশ পরমাণু যুগে প্রবেশ করল, এটা জাতীয়ভাবে ভালো খবর। শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়, এ প্রকল্প জাতীয় আত্মবিশ্বাস তৈরিতে সহায়তা করবে,” বেনারকে জানান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান।

যদিও আন্তর্জাতিক শক্তি কমিশন এখনো বাংলাদেশকে নিউক্লিয়ার ক্লাবের সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।

তবে এটি এখন সময়ের ব্যাপার জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “এর জন্য সামান্য কিছু আনুষ্ঠানিকতা বাকি রয়েছে। শিগগিরই তা সম্পন্ন করা হবে।” তাঁর মতে, এ ধরনের প্রকল্প বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত করেছে।

গত ৪ নভেম্বর ‘ডিজাইন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লাইসেন্স’ দিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি অথোরিটি (বিএইআরএ)। ওই দিন আনুষ্ঠানিকভাবে আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান দিলীপ কুমার সাহার কাছে এই লাইসেন্স তুলে দেন বিএইআরএর চেয়ারম্যান নঈম চৌধুরী।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তত্ত্বাবধানে এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও নির্মাণকাজ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু সংস্থা রোসাটম। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ১৩২০ কোটি ডলার ব্যয়ের ৯০ শতাংশ (১১৮৮ কোটি ডলার) ঋণ হিসেবে দিচ্ছে রাশিয়া। অবশিষ্ট ১০ শতাংশ দেবে সরকার।

শর্ত সাপেক্ষে লাইসেন্স

পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষতিকারক দিকগুলো সম্পর্কে দেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আণবিক শক্তি কমিশনকে ডিজাইন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লাইসেন্স দিলেও বেশ কিছু শর্তসাপেক্ষে তা দিয়েছে বিএইআরএ।

শর্তগুলো হলো; প্রকল্প এলাকার বেলেমাটি পরমাণু চুল্লি (রিঅ্যাক্টর) স্থাপনের উপযোগী করে তোলা, প্রকল্পের অবকাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পদ্মাপাড়ের প্রতিরক্ষা বাঁধকে নিরাপদ করে তোলা, জরুরি অবস্থায় ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের জায়গাটি ১০০ বছর চলার মতো মজবুত ও টেকসই কি না তা নিশ্চিত করা।

এগুলো নিশ্চিত হওয়ার পরে বিআরবিএ চূড়ান্ত লাইসেন্স দেবে বলে জানা যায়।

আণবিক শক্তি কমিশন সূত্র জানায়, এসব কাজ শেষ করে আগামী বছরের মার্চ মাসের মধ্যেই তারা নিঃশর্ত লাইসেন্স পাওয়ার আশা করছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে সর্বাধুনিক থ্রি প্লাস জেনারেশন ‘ভিভিইআর ১২০০’ প্রযুক্তির পারমাণবিক চুল্লি ব্যবহার করা হবে। এটি রাশিয়ারই উদ্ভাবিত।

পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা স্বীকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, “প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটবে না, সেটা বলা যাবে না। তবে বর্তমান সময়ের প্রযুক্তি অনেক উন্নত। ক্ষতির আশঙ্কা অনেক কম।”

মূল পর্বের কাজ শুরু, উদ্বোধন ৩০ নভেম্বর

প্রকল্প ব্যবস্থাপনা সূত্র জানায়, মূল নির্মাণপর্বের কিছু কিছু কাজ আসলে শুরু হয়ে গেছে। গত সেপ্টেম্বরে এই পর্বের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা পিছিয়ে অক্টোবরে যায়। এখন নির্মাণপর্বের ভিত্তি তৈরির প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৩০ নভেম্বর পাবনার রূপপুরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির মূল পর্বের অর্থাৎ পরমাণু চুল্লি বসানোর কাজের (ফাস্ট কংক্রিট পোরিং ডেট বা এফসিডি) উদ্বোধন করবেন। এরপরেই চুল্লি বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে।

এই পর্ব উদ্বোধনের পর ৬৮ মাস লাগবে প্রথম ইউনিট চালু হতে। সে হিসাবে ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথমটি ২০২৩ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করবে। দ্বিতীয়টি চালু হবে ২০২৪ সালে। অর্থাৎ দুই ইউনিট বিশিষ্ট রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক বেনারকে বলেন, “আর্থিক বিবেচনায় রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র এ সরকারের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রকল্পটি দেশের আর্থ–সামাজিক উন্নয়নে অনেক বড় ভূমিকা রাখবে।”

প্রকল্পে ভারতের বড় ধরনের ভূমিকা

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল নির্মাণপর্বে ভারতীয় বিশেষজ্ঞ নিয়োগের পরিকল্পনা করেছে প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু সংস্থা ‘রোসাতোম’। সরকারও এই প্রকল্পের জন্য পরামর্শক সেবা ও জনবল তৈরিতে ভারতের সহায়তা নিচ্ছে। ফলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজে ভারতের বড় ধরনের ভূমিকা থাকবে।

সরকারি সূত্র জানায়, গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার ও উন্নয়নে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার লক্ষ্যে যে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে তার আওতায় ভারতের কাছ থেকে রূপপুর প্রকল্পের জন্য পরামর্শক সেবা নেওয়া হচ্ছে। এই প্রকল্পের জন্য জনবল তৈরি ও প্রশিক্ষণেও ভারত সহায়তা দেবে।

কোনো দেশে পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করার জন্য যে রকম জনবল থাকা প্রয়োজন এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের তা নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, রূপপুর প্রকল্পের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল লাগবে প্রায় দুই হাজার।

রূপপুর প্রকল্পকে সামনে রেখে রাশিয়া ও ভারতের সহায়তায় জনবল তৈরির কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এই কার্যক্রমও যথেষ্ট নয় বলে সরকারি-বেসরকারি সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে।

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী রূপপুর প্রকল্পের জন্য রাশিয়া এক হাজার ১০০ পেশাজীবী কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেবে। এ ছাড়া, বাংলাদেশের ৫০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী রাশিয়ার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরমাণু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করছেন।

ড. মো. শফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমাদের এখন মাথাপিছু বিদ্যুৎ ৩৭৮ কিলোওয়াট আওয়ার। মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে জনপ্রতি এক হাজার কিলোওয়াট আওয়ারের বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে।”

তিনি আরও বলেন, “বিদ্যুৎ ছাড়া ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আবার কমে আসা গ্যাস সম্পদ ও রপ্তানি নির্ভর কয়লা দিয়েও এই বিদ্যুতের এই লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব। তাই পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখন সময়ের দাবি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।