রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল কাজ শুরু

জেসমিন পাপড়ি
2017.11.30
ঢাকা
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম কংক্রিট ঢালাইয়ের শুভ সূচনা ও ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম কংক্রিট ঢালাইয়ের শুভ সূচনা ও ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৩০ নভেম্বর ২০১৭।
ফোকাস বাংলা।

অবশেষে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল নির্মাণ শুরু করল বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার নিজের হাতে প্রথম কংক্রিট ঢালাইয়ের মাধ্যমে এই কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আর এরই মাধ্যমে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ৩২ তম দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হলো। শুরু হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাস্তব হয়ে ওঠার ক্ষণ গণনা।

এ সময় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আজ আমরা পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল কাঠামোটা নির্মাণ শুরু করছি। অর্থাৎ আমরা পরমাণু বিশ্বে প্রবেশ করলাম। দিনটি আমাদের জন্য সত্যি আনন্দের।”

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ডা. আ ফ ম রুহুল হক বেনারকে বলেন, “আজ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করার প্রথম ধাপে পৌঁছে গেল বাংলাদেশ। অর্থাৎ আমরা প্রথম মাইল স্টোনে পা রাখলাম। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুবিধা পাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।”

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় পদ্মাতীরের রূপপুরে ২৬২ একর জমির উপর বহু কাঙ্ক্ষিত এই বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ হচ্ছে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তত্ত্বাবধানে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু সংস্থা রোসাটম এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও নির্মাণকাজ করছে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শেষ করার জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার অ্যাটমস্ট্রয়েক্সপোর্টের জন্য নির্ধারিত সময় আজ থেকে সাড়ে পাঁচ বছর বা ৬৬ মাস। অর্থাৎ ২০২৩ সালের মে থেকে জুন মাসে ১২০০ মেগাওয়াট সম্পন্ন প্রথম ইউনিটটি চালু হওয়ার কথা। ২০২৪ সালে একই ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিট চালু হবে।

প্রসঙ্গত, ১৯৬১-৬২ সালে সর্বপ্রথম এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এরপর নানা কারণে বারবার পিছিয়ে গেলেও ২০১১ সালের ২ নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ-রাশিয়ার মধ্যকার সহযোগিতা চুক্তি সই হলে প্রকল্পটির কাজে গতি আসে। এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত ১৩২০ কোটি ডলার ব্যয়ের ৯০ শতাংশ (১১৮৮ কোটি ডলার) ঋণ হিসেবে দিচ্ছে রাশিয়া। অবশিষ্ট ১০ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ।

বিশ্বে এখন ৩১টি দেশে মোট ৪৫০টি পারমাণবিক বিদ্যুতের ইউনিট বিদ্যমান। এই বিদ্যুৎ ইউনিটগুলো প্রায় ৩ লাখ ৯২ হাজার মেগাওয়াট (৩৯২ গিগাওয়াট) ক্ষমতা সম্পন্ন। বাংলাদেশসহ ৬১টি দেশে প্রায় ৬০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৬০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ ইউনিট নির্মাণাধীন রয়েছে। বাংলাদেশ এখন পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী দেশ হিসেবে এশিয়ায় ষষ্ঠ এবং সার্কের দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয়।

নিরাপত্তায় প্রাধান্য

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে রাশিয়ার নিজস্ব সর্বাধুনিক (থ্রি প্লাস জেনারেশন) ‘ভিভিইআর ১২০০’ প্রযুক্তির পরমাণু চুল্লি ব্যবহার করা হবে।

এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে পারমাণবিক এবং রেডিওলজিক্যাল নিরাপত্তার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে নানা সমালোচনার জবাবও দেন তিনি।

যে কোনো দুর্যোগে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কোনো প্রকার দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে, সে বিষয়টি খেয়াল রেখে এই প্ল্যান্টের ডিজাইন করা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে পারমাণবিক নিরাপত্তার উপর আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা’র (আইএইএ) গাইডলাইন অক্ষরে-অক্ষরে অনুসরণ করে নির্মাণের প্রতিটি স্তরে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হচ্ছে।”

শেখ হাসিনা জানান, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ নামে একটি স্বাধীন পারমাণবিক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। এই সংস্থা নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ইতিমধ্যে আইএইএ এবং রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ সংক্রান্ত সকল ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং প্রটোকলে অনুস্বাক্ষর করেছে বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, “এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার করতে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল তৈরির জন্য প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। পরিবেশ ও মানুষের যাতে ক্ষতি না হয় তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”

সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যে কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ তার ব্যবহৃত জ্বালানি বা বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাপনা। রুশ ফেডারেশন এসব বর্জ্য তাদের দেশে ফেরত নিয়ে যাবে। এ বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে।”

এই প্রকল্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আশাবাদী বিশেষজ্ঞরাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “জাপানসহ উন্নত অনেক দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে ক্ষতি এড়াতে পারেনি, এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া হয়। তবে সেই সময়ের তুলনায় প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত। এখন এমন প্রযুক্তি এসেছে যে, একটা দুর্ঘটনা যদি ঘটেও, তাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কিছুটা ক্ষতি হলেও রেডিয়েশন মানুষের কাছে, পানিতে বা মাটিতে যাবে না। এমনকি আশপাশের মানুষ জানতেও পারবে না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।