শ্রম আইন সংশোধন বিল সই না করে ফেরত পাঠালেন রাষ্ট্রপতি
2023.11.27
ঢাকা
বাংলাদেশের শ্রম আইনের একটি সংশোধিত বিল জাতীয় সংসদে পাশ হওয়ার পর স্বাক্ষর না করে ফেরত পাঠিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন। তাঁর এই বিরল পদক্ষেপের কারণে বিলটি এখনই আইনে পরিণত হচ্ছে না।
সোমবার জাতীয় সংসদ সচিবালয় রাষ্ট্রপতির দেওয়া মতামতসহ এই বিষয়ে একটি বুলেটিন প্রকাশ করেছে। ওই বুলেটিনের একটি অনুলিপি বেনারের হাতে এসেছে।
রাষ্ট্রপতির মতামতের অংশে বলা হয়েছে, “এই বিলের দফা-৪৫ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। কাজেই উক্ত দফা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৮০(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদে ফেরত পাঠানো হলো।”
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের প্রেস সচিব জয়নাল আবেদিনও বিষয়টি বেনারকে নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি ১৫ দিনের মধ্যে কোনো বিলে সম্মতি দিলে সেটি আইনে পরিণত হবে। তবে সংসদে পাশকৃত কোনো বিল পুনর্বিবেচনা বা বিলের উপর নিজের প্রস্তাবিত সংশোধনী বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে বিল সংসদে ফেরত পাঠানোর ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছে।
তবে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা প্রয়োগের নজির দেশটিতে বিরল।
সর্বশেষ ১৯৯৮ সালের ৮ ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সপ্তম সংসদে পাস হওয়া ‘দি কোড অব সিভিল প্রসিজার (সংশোধন) বিল, ১৯৯৮’ স্বাক্ষর না করে ফেরত পাঠিয়েছিলেন।
যা নিয়ে ‘বিভ্রান্তি’
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২০০৬ সালে শ্রম আইন পাস হয়। প্রবর্তনের পর থেকে একাধিকবার এই আইন সংশোধন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকার নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্বেগের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার চলতি মেয়াদের শেষ দিকে আবারও আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়।
মূল আইনের ২৯৪ ধারার প্রথম উপধারায় বেআইনি ধর্মঘট শুরু করা বা অব্যাহত রাখার জন্য শ্রমিকের বিরুদ্ধে কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। একইভাবে আইনের দ্বিতীয় উপধারায় বেআইনিভাবে কারখানা বন্ধ রাখার জন্য মালিকের বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড বা উভয়দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শ্রম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো. তৌফিকুল আরিফ সোমবার বেনারকে বলেন, শ্রম আইনের সংশোধনী চলার সময় মন্ত্রীসভা মূলত দ্বিতীয় উপধারাটি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কারখানা বেআইনিভাবে বন্ধ করলে বা সেটি চালিয়ে গেলে মালিকের শাস্তি বৃদ্ধি হওয়ার কথা।
কিন্তু জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে পাশ হওয়া সংশোধন বিলে দেখা গেছে, মালিকের শাস্তি বাড়ানোর বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে, তবে শ্রমিকের শাস্তি বাড়ানো হয়েছে।
এই কারণে “বিভ্রান্তি” সৃষ্টি হতে পারে বলে মন্তব্য করে ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল, ২০২৩’ স্বাক্ষর না করে সংসদের কাছে ফেরত পাঠিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য শাজাহান খান এই বিষয়ে বেনারকে বলেন, “এটি মন্ত্রণালয়ের ভুল। হয়তো তারা তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মালিকের পরিবর্তে কেবল শ্রমিকদের শাস্তি বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে।”
তিনি যোগ করেন, “আরও কয়েক দিন সময় বেশি দেওয়া হলে আমরা স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করে বিষয়টি সংশোধন করতে পারতাম। তবে যেখানেই হোক ভুলটি ধরা পড়েছে সেটিই বড় কথা।”
কিন্তু ঠিক কী কারণে বা কীভাবে এই ভুলটি হয়েছে — তা স্পষ্ট নয়।
সংশোধনীর প্রেক্ষাপট
২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ার ঘটনার পর বাংলাদেশে শ্রম অধিকার নিয়ে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র সহ পোশাক আমদানিকারক দেশগুলো সরকারকে কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের প্রক্রিয়া সহজীকরণের বিষয়ে তাগিদ দিতে থাকে। বিশেষ করে, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে স্থাপিত কল-কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন চালুর বিষয়ে দেশগুলোর চাপ ছিল।
শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ ছিল, এসব কারখানায় ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ না থাকায় মালিকপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের কোনো সুরক্ষাকবচ নেই। অপরদিকে মালিকপক্ষের অনেকেই শ্রমিক ইউনিয়ন নিয়ে নিজেদের বিরূপ মনোভাব প্রকাশে রাখঢাক রাখেননি।
এরই প্রেক্ষাপটে সরকার ফের শ্রম আইন সংশোধনের দীর্ঘ উদ্যোগ নেয়। নতুন সংশোধনীতে কল-কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করা হয়েছে।
সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মরত মোট শ্রমিকের সংখ্যা ৩,০০০ পর্যন্ত হলে ২০ শতাংশ এবং এর বেশি হলে ১৫ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে। বিদ্যমান আইনে ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে শ্রমিক সংখ্যা নির্বিশেষে ২০ শতাংশ শ্রমিকের লিখিত সম্মতি প্রয়োজন হয়।
প্রতিষ্ঠানপুঞ্জের ক্ষেত্রে আগের ৩০ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতিতে ট্রেড ইউনিয়ন করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে।
সংশোধিত আইনে নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে ১২০ দিন করার প্রস্তাব করা হয়। এছাড়াও “মহিলা” শব্দের স্থলে প্রথমবারের মতো “নারী” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনে গত ২ নভেম্বর কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়। রাষ্ট্রপতি ফেরত পাঠানোর পর এখন নতুন নির্বাচনের পর দ্বাদশ সংসদ দায়িত্ব গ্রহণের পরই কেবল বিলটির পুনর্বিবেচনা সম্ভব।