নতুন কর্মসূচি “মার্চ ফর জাস্টিস”
2024.07.30
আন্দোলনকারীদের প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন কর্মসূচি “মার্চ ফর জাস্টিস” ঘোষণা করেছে মঙ্গলবার রাতে।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বাংলাদেশে সাধারণ শিক্ষার্থী ও অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর সরকারের ক্র্যাকডাউন নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র পৃথক সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে, অপরদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজেদের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে মঙ্গলবার।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশে সংঘটিত সকল সহিংস ঘটনাকে অবিলম্বে স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা এবং দায়ীদের জবাবদিহিতার জন্য তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চ প্রতিনিধি জোসেপ বোরেল পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র বলেছে চলমান পরিস্থিতির স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় তারা।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণে উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ
বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার (বাংলাদেশে সময় মঙ্গলবার) জাতিসংঘ মহাসচিবের দেওয়া একটি বিবৃতি পড়ে শোনান জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে হাজারো তরুণ ও বিরোধী রাজনৈতিকদের গণগ্রেপ্তার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের খবরেও জাতিসংঘ মহাসচিব উদ্বিগ্ন।
যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
সহিংসতার সব ঘটনা অবিলম্বে স্বচ্ছ-নিরপেক্ষভাবে তদন্তসহ দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে তিনি তাঁর আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা ও নিউইয়র্ক উভয় স্থানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে উদ্বেগ জানানো অব্যাহত রাখবে বিশ্ব সংস্থাটি।
জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে সেনা পাঠানোর ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় দেশ হিসেবে তারা বাংলাদেশকে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং তা সমুন্নত রাখার বিষয়টি মনে করিয়ে দেয় জাতিসংঘ।
স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় যুক্তরাষ্ট্র
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে যেকোনো শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অবিচল সমর্থন দেওয়ার কথা পুনর্ব্যক্ত করার পাশাপাশি চলমান পরিস্থিতির স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় যুক্তরাষ্ট্র।
সোমবার (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার) মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন উপপ্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল।
“বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অবিচল সমর্থন রয়েছে। সেখানে ইন্টারনেট যোগাযোগ কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তবে জনগণকে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সুযোগ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ এবং আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারবে,” বলেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করতে চায়, আমরা অবশ্যই তাদের সমর্থন করি।
পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন
চলমান এই আন্দোলন ঘিরে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক–প্রধান জোসেপ বোরেল এ উদ্বেগের কথা বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছেন বলে মঙ্গলবার ইইউর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়।
ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ২৭ জুলাই লাওসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোটের (আসিয়ান) আঞ্চলিক ফোরামের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
“আমি (জোসেপ) বাংলাদেশের প্রতিনিধি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে সেখানে সাম্প্রতিক দিনগুলোয় কর্তৃপক্ষের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছি,” বলেন তিনি।
তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ড, সহিংসতা, নির্যাতন, গণগ্রেপ্তার ও সম্পদের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়েও গভীর উদ্বেগ রয়েছে তার।
এসব কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রীকে অ্যামনেস্টির চিঠি
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে চলমান দমন-পীড়ন বন্ধ করতে এবং দমন-পীড়নের ফলে যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে তার একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ, কার্যকর, স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করতে জাতিসংঘকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাগনেস ক্যালামার্ড।
ছাত্র বিক্ষোভকারীদের গণগ্রেফতার এবং নির্বিচারে আটক করা আরও ভয়ের পরিবেশকে স্থায়ী করেছে দাবি করে এই চিঠিতে বলা হয়, শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার অধিকার প্রয়োগ করার জন্য আটক বা গ্রেপ্তারকৃত সকলকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
দুই মার্কিন সিনেটরের নিন্দা
মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির চেয়ারম্যান বেন কার্ডিন এবং সিনেটর কোরি বুকার ছাত্র বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ ও সহিংসতার জন্য বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনীর নিন্দা জানিয়েছে। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে দুই সিনেটর বলেন, এই ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নিরাপত্তা বাহিনীগুলির মধ্যে একটি ইউনিট রয়েছে যার নেতারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়েছেন।
"শান্তিপূর্ণভাবে সমবেত হওয়া এবং প্রতিবাদ করার অধিকার একটি গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম ভিত্তি। আমরা বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনার পাশাপাশি প্রতিবাদকারীদের অধিকারকে সম্মান করার আহ্বান জানাই," বিবৃতিতে বলা হয়।
নিরাপত্তার নামে ৬ সংগঠককে আটক, হাইকোর্টের প্রশ্ন
হাইকোর্ট মঙ্গলবার কোটাবিরোধী আন্দোলনের ছয় সংগঠককে নিরাপত্তার নামে পুলিশি হেফাজতে আটক রাখার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
পুলিশ হেফাজতে আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে মুক্তি এবং আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না ছুড়তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানিকালে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এসএম মাসুদ হোসেন দোলনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ প্রশ্ন তোলেন।
“তাদেরকে কেন তাদের আটক করা হয়েছে? এটা কোনো প্রক্রিয়া হতে পারে না। হয় তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে না হলে ছেড়ে দিতে হবে,” শুনানির সময় এ কথা বলেন আদালত।
হাসপাতাল ও অন্যান্য স্থান থেকে তুলে নিয়ে ‘নিরাপত্তা’ দেওয়ার নামে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে শুক্রবার থেকে চারদিন পর্যন্ত হেফাজতে রেখেছে পুলিশ।
এদের মধ্যে নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বকের মজুমদারকে শুক্রবার বিকেলে ঢাকার একটি হাসপাতাল থেকে তুলে নেওয়া হয়, গোয়েন্দারা শনিবার বিকেলে দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ এবং রবিবার সকালে আরেক সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে তুলে নিয়ে যায়।
মঙ্গলবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে সুশীল সমাজের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিত্বকারী একদল বিশিষ্ট নাগরিক এই ছয় সমন্বয়কারীকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার দিকে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, “২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছয়জন সমন্বয়ককে মুক্তি না দিলে সুশীল সমাজ ডিবি (ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা) কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবে এবং সেখান থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।”
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে প্রাণহানির ঘটনায় মঙ্গলবার সারাদেশে শোক পালন করেছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তি। নিহতদের আত্মার মাগফিরাত এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে বিভিন্ন মসজিদে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। কালোব্যাজ ধারণ করেন অনেকেই।
অপরদিকে, ছাত্রদের ওপর নির্যাতন ও পূর্বঘোষিত ৯ দফা দাবি আদয়ের পক্ষে চোখে মুখে লাল কাপড় বেধে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালর করা হয়। এর পাশাপাশি নিজেদের প্রোফাইল লাল করে দিয়েছেন শত শত মানুষ।
দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষেরা চলমান সহিংসতার প্রতিবাদ জানিয়ে ঢাকার গুলিস্তান এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন, সেখানে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হয়।
নতুন কর্মসূচি “মার্চ ফর জাস্টিস”
আন্দোলনকারীদের প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে মঙ্গলবার রাতে।
আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের জানান, সারাদেশে ছাত্র-জনতার উপর গণহত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা, গুম এবং খুনের প্রতিবাদে ও জাতিসংঘ কর্তৃক তদন্তপূর্বক বিচারের দাবিতে এবং ছাত্র সমাজের ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দেশের সকল আদালত, ক্যাম্পাস এবং রাজপথে বুধবার সাগে ১২টায় “মার্চ ফর জাস্টিস” কর্মসূচি পালন করা হবে।
“আমরা সারাদেশের শিক্ষক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী ও সকল নাগরিককে আমাদের কর্মসূচি পালনে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও আমাদের দাবি আদায়ের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি,” বলা হয় বিবৃতিতে।