দেশের ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থির পরিস্থিতি

জেসমিন পাপড়ি
2019.09.25
ঢাকা
190925_universities_1000.jpg গোপালগঞ্জ শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ঝাড়ু মিছিল। ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
[নিউজরুম ফটো]

ছাত্র আন্দোলনের মুখে উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধে রয়েছে দেশের অন্তত ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ উপাচার্য বা প্রক্টরের বিরুদ্ধে। অস্থিরতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

ইতিমধ্যে ছাত্র আন্দোলনের মুখে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে গোপালগঞ্জ শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। তবু উপাচার্যের পদত্যাগ না করা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

নানা অনিয়মের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেমে থেমে আন্দোলন চলছে। উত্তেজনা বিরাজ করছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে কয়েক মাস ধরে নিয়মিত উপাচার্যই নেই। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ও উপাচার্যহীন প্রায় চার মাস। অস্থিরতা চলছে জাহাঙ্গীরনগর ও কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষকদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের অভাব, প্রশাসনের দুর্বলতা, বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট প্রভৃতি কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক ধরনের অরাজকতা চলছে। এতে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লেখাপড়া।

শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বেনারকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে রাজনৈতিক দলীয় লেজুড়বৃত্তি, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধের অভাব, টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি এবং এক ধরনের দলীয় রাজনীতির কুপ্রভাব পড়ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।”

তিনি বলেন, “ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসন সর্বত্র এক ধরনের মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায়।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আ আ স ম আরেফিন সিদ্দিক বেনারকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি অচলাবস্থায় পড়ে যায়, তাহলে উচ্চ শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। যা দেশের সার্বিক অগ্রযাত্রায় বাধা সৃষ্টি করে।”

তাঁর মতে, “বর্তমানে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে সামগ্রিকভাবে তার মূল কারণ আস্থার সংকট, বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কট।”

আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে এক ধরনের অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে। এই অবিশ্বাসের কারণ কোথাও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ, কোথাও ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ, কোথাও আবার স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি।”

তিনি বলেন, “দুপক্ষের মধ্যে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবস্থায় অভিযোগগুলো তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।”

“বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ব্যবহার করে সমস্যার সমাধান না হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) দায়িত্ব নিতে হবে,” মনে করেন ড. আরেফিন।

বন্ধ হলেও চলছে আন্দোলন

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসের জেরে গত ১১ সেপ্টেম্বর এক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের কারণে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপাচার্যের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠলে বহিষ্কারাদেশ তুলে নেন উপাচার্য। তবে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি থেকে সরে আসেনি শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে ২১ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নূর মোহাম্মদ বেনারকে বলেন, “উপাচার্য স্যারের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতি করে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিউটি পারলারের ব্যবসা চালু করাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারিও রয়েছে।”

তিনি নিজের গুন্ডা বাহিনী দিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করান। এতে কমপক্ষে ৩০ জন শিক্ষার্থী আহত হন। যার প্রতিবাদে আমাদের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর হুমায়ূন কবির পদত্যাগ করেন।”

তবে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে এ ঘটনার নিন্দা জানান উপাচার্য প্রফেসর ড. খোন্দকার নাসির উদ্দিন। ২২ সেপ্টম্বর দেওয়া এক বিবৃতিতে এ ঘটনার তদন্ত করারও আশ্বাস দেন তিনি।

অস্থিরতার মূলে অডিও রেকর্ড

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলামকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে সরকার সমর্থক এই ছাত্রসংগঠনের একাংশ। ৪০ লাখ টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদকের পদ নেওয়ার বিষয়ে অডিও ফাঁস হলে তাঁকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।

এরপর তাঁকে কয়েক দফা ক্যাম্পাস থেকে ধাওয়া দিয়ে বের করা হয়। এই ইস্যুতে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা চলছে।

এদিকে ছাত্রলীগের আন্দোলনের মুখে ২৩ সেপ্টেম্বর প্রক্টর মাহবুবর রহমানকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন প্রক্টর নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ

উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়মের প্রেক্ষাপটে উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলামের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন করছেন ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ। তবে উপাচার্য ফারজানা ইসলাম এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।

উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে বুধবারও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কর্মসূচি পালন করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে উপাচার্যের বিভিন্ন অনিয়মের ‘তিরস্কারনামা’ পাঠ ও কালো পতাকা প্রদর্শন করা হয়।

‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে অনুষ্ঠিত এই কর্মসূচিতে ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম উপাচার্যের অনিয়মের বিরুদ্ধে ‘তিরস্কারনামা’ পাঠ করেন। এতে তিনি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মামলা, উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের জন্য ই-টেন্ডার আহ্বান না করা, সুনির্দিষ্ট কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেওয়া, ছাত্রলীগকে দুই কোটি টাকা ভাগাভাগি করে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরে উপাচার্যকে তিরস্কার করেন।

মানববন্ধনে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, “আমরা আশা করছি, তিনি (উপাচার্য) আগামী সাত দিনের মধ্যেই পদত্যাগ করে নিজে ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়মুক্ত করবেন।”

পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি করানোর অভিযোগ

সম্প্রতি ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থী ভর্তি করানোসহ নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের বিরুদ্ধে। বর্তমানে যিনি অনির্বাচিত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের অন্যতম প্রধান এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে থেমে থেমে উপাচার্য বিরোধী আন্দোলন চলছে।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “ভিসির সহযোগিতায় ছাত্রলীগের ৩৪জন নেতাকে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্সে ভর্তি করানো হয় বলে সংবাদমাধ্যমে আমরা জানতে পারি। উপাচার্য হয়ে তিনি এ ধরনের অন্যায় করে পার পেতে পারেন না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান অবশ্য বলেছেন, “এই ৩৪ শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়টি তদন্ত করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।”

এদিকে আড়াই মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য প্যানেল মনোনীত করে সরকারের কাছে পাঠায়। সরকার-সমর্থক এই প্যানেল থেকে ভোটাভুটিতে প্রথম হয়েছেন উপ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদ আর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন বর্তমান উপাচার্য। তবে সরকার প্যানেল থেকে কাউকে উপাচার্য নিয়োগ দেয়নি।

এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বেনারকে বলেন, ‘বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি নিয়ে আমরা অবহিত রয়েছি। গোপালগঞ্জ শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলছে।”

যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত শেষে কমিটির প্রতিবেদন ও সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে জানান তিনি।

ড. শহীদুল্লাহ বলেন, “ইউজিসি ব্যবস্থা নিতে পারে না। আমাদের দায়িত্ব সুপারিশ করা। শতভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে তদন্ত কমিটিগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশা করি অপরাধ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।”

তিনি বলেন, “দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ মিললে অপসারণের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া উচিত।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।