বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে ঢাকার রাস্তায় প্রতিবন্ধীরা

প্রাপ্তি রহমান
2018.10.12
ঢাকা
181012_Physically_challanged_students_1000.JPG কোটার দাবিতে শাহবাগে প্রতিবন্ধীদের অবস্থান। ১১ অক্টোবর ২০১৮।
নিউজরুম ফটো

সরকারি চাকরিতে কোটা বহালের দাবিতে ঢাকার শাহবাগে অবস্থান নিয়েছেন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ঐক্য পরিষদ বলেছে, সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা বহালের ঘোষণা না আসা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।

গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টা থেকে বিরতি ছাড়াই চলছে এই কর্মসূচি, দ্বিতীয় দিনের মতো শুক্রবারও তা অব্যাহত ছিল। দিনভর বৈরী আবহাওয়া থাকলেও শাহবাগ মোড় ছাড়েননি প্রতিবন্ধীরা। রাত দশটা পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে কোনো আশ্বাস পাননি তাঁরা।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মোর্চা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। আরও সংহতি জানিয়েছে, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন।

শুক্রবার বিকেল ৫ টায় শাহবাগে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কর্মসূচি ঘোষণা করে। পরিষদের আহ্বায়ক আলী হোসাইন এ সময় বলেন, দাবি বাস্তবায়নে তাঁরা কঠোর ও লাগাতার আন্দোলন গড়ে তুলবেন।

“আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধীবান্ধব, কিন্তু তাঁর আশেপাশে থাকা লোকেরা প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে হয়তো ধারণাই রাখেন না৷ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা এই রাস্তায় রাতভর লম্বালম্বি শুয়ে অবস্থান করব,” জানান আলী হোসাইন।

সংবাদ সম্মেলন শেষে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি লিংকন দিব্রা। তিনি প্রতিবন্ধী কোটা সংরক্ষণের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য সরকারি চাকরিতে ৫ শতাংশ কোটা বহাল রাখার দাবি জানান।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বড় অংশ রাস্তায় নামে। নানা নাটকীয় ঘটনার পর গত ৩ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এরপরই কোটার সুবিধা যারা ভোগ করে আসছিলেন, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামেন।

কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারির আগে বাংলাদেশে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনি, ১০ শতাংশ নারী, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও এক শতাংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্ধারিত ছিল।

অন্য সব কোটা বাতিলে আইনগত কোনো বাধা না থাকলেও প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা ব্যবস্থা চালু রাখার আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে বলে জানান সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।

৩ অক্টোবর তিনি বেনারকে বলেন, “প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা রাখার আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে। ২০১৩ সালের এক আইনে প্রতিবন্ধীদের জন্য এই কোটা সুরক্ষিত।”

প্রতিবন্ধীরা যে কারণে রাজপথে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আলী হোসাইন বেনারকে বলেন, কোটার নামে বরাবর তাঁদের সঙ্গে সরকার প্রহসন করে আসছে। গত বছরের অক্টোবরে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ১ শতাংশ কোটা সুনির্দিষ্ট করার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। এর মধ্যে নতুন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সেই সুবিধা হরণ করা হলো।

“২০১৩ সালে সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ কোটা সংরক্ষণের প্রজ্ঞাপন জারি কর​লেও শর্ত বেঁধে দেয় যে, বাকি ৫৫ শতাংশ কোটার মধ্যে যে কোটায় পর্যাপ্ত সংখ্যক যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাবে না, সেই কোটার ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করতে হবে। এতে করে আমরা এক শতাংশ কোটার সুবিধা এমনিতেই পুরোপুরি পাচ্ছিলাম না,” বলেন আলী হোসাইন।

দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর গত বছর উচ্চ আদালত ১ শতাংশ কোটা সবসময় সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। কিন্তু আদালত আদেশ দিলেও সরকার নতুন করে সিদ্ধান্ত দেওয়ায় তাঁরা আবার আটকা পড়লেন বলে ধারণা করছেন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা।

প্রতিবন্ধীদের ১১ দফা

শাহবাগে তাঁরা জমায়েত হয়েছেন ১১ দফা দাবি নিয়ে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিনা শর্তে সব পর্যায়ের চাকরিতে ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ, বিসিএসের প্রাথমিক পর্ব থেকে কোটা কার্যকর, চাকরি পরীক্ষায় ১০ মিনিট অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ রাখা, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সসীমা বাড়ানো ইত্যাদি।

শুক্রবার প্রতিবন্ধীদের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান লিটু। তিনি বলছিলেন, “কোটা প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো ‘উপহার’ নয়, এটা তাঁদের অধিকার।”

২০০২ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে একটি গবেষণার জন্য প্রতিবন্ধী ও তাঁদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেন ওই শিক্ষক। তাঁর গবেষণায় বেরিয়ে আসে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হলেও প্রতিবন্ধীদের অভিভাবকেরা সন্তানের উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হচ্ছেন না। এর কারণ হিসেবে তাঁরা কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকার কথা উল্লেখ করেন।

মাহবুবুর রহমান বলেন, ২০১২ সালে যখন কোটা রাখার কথা বলা হয় তখন অভিভাবকদের অনেকেই তাঁদের ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার বিষয়ে আগ্রহী হন, যদিও এই সংখ্যা এখনও অনেক কম।

ওই শিক্ষক জানান, সরকারি বিভিন্ন নথিতে দেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিবন্ধী বলে বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো জরিপ কখনও করেনি বলে জানান তিনি।

সবাই প্রতিবন্ধী কোটার পক্ষে

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী প্রতিবন্ধীদের আন্দোলনে সংহতি জানান। তিনি কোটা সংরক্ষণের জন্য প্রতিবন্ধীদের এই আন্দোলনে ছাত্রলীগের পূর্ণ সমর্থন আছে বলে উল্লেখ করেন।

এদিকে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নূরুল হক নূর বলেন, সরকারের কৌশল দেখে তাঁরা হতাশ। ছাত্র সমাজের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির জন্য সরকার কোটা বাতিল করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

“প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা আমাদের সঙ্গে আন্দোলন করেছে। আমরা তাঁদের দাবির সঙ্গে একমত। সরকার আসলে ছাত্র সমাজের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে চায়,” নুরুল হক নূর বেনারকে বলেন।

এদিকে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটার প্রয়োজন রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনেরা। তাঁরা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করারও দাবি জানিয়েছেন।

শুক্রবার রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেন, প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা প্রয়োজন আছে। তবে কোটা নির্ধারণ করার আগে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। কোটার সুবিধা নিতে হলে আগে শিক্ষিত হতে হবে।

ড. খান বলেন, দেশের মাত্র ৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিক্ষার সুযোগ পায়। তাঁদের জন্য শিক্ষার সুযোগ করতে হবে। এর জন্য শুধু নীতিমালা করলে হবে না। বিনিয়োগ, শিক্ষক, অবকাঠামোর প্রয়োজন আছে।

আকবর আলি খান বলেন, প্রতিবন্ধীদের সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হবে। সামাজিক ও মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের প্রতিষ্ঠায় সরকারকে নিরন্তর উদ্যোগ নিতে হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।