পরিবহন ধর্মঘটে দেশজুড়ে শ্রমিকদের নৈরাজ্য

জেসমিন পাপড়ি
2018.10.29
ঢাকা
181029_transport-strike_1000.jpg সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটে প্রায় যানবাহনশূন্য ঢাকার একটি সড়ক। ২৯ অক্টোবর ২০১৮।
বেনারনিউজ

সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে পরিবহন শ্রমিকদের কর্মবিরতির দ্বিতীয় দিনেও সারা দেশে বাস ও পণ্যবাহী কোনো যান চলেনি। ধর্মঘটের নামে দেশজুড়ে চলেছে শ্রমিকদের নৈরাজ্য।

নৌ পরিবহন মন্ত্রী ও শ্রমিক নেতা শাহজাহান খানের নেতৃত্বাধীন সংগঠনের শ্রমিকেরা ৪৮ ঘণ্টার এই ধর্মঘট ডেকেছিল। এই আইন পাশ করার সব স্তরেই তাঁর ভূমিকা ছিল। গত দুইদিন এ বিষয়ে মুখ খোলেননি মন্ত্রী।

ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনে সোমবার ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকেও যোগ দেননি শাহাজাহান খান।

এদিকে টানা দুই দিন সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হলেও পরিস্থিতি নিরসনে সরকারকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। তবে শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী সড়ক পরিবহন আইনের ধারা সংশোধন করা যে সম্ভব নয়, তা স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বেনারকে বলেন, “ধর্মঘটের নামে যেভাবে প্রাইভেট কার, সিএনজি, রিকশার চলাচলে বাধা দেওয়া হয়েছে, চালক ও যাত্রীদের মুখে মোবিল মাখিয়ে হেনস্তা করা হয়েছে; এটাকে নৈরাজ্য ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।”

তিনি আরও বলেন, “যে আইনটা পাস হয়েছে সেটাতে তো পরিবহন নেতারাই সই করেছেন। আর যদি কোনো আপত্তিও থাকে তাহলে তো সেটা আলোচনা করে সমাধান করা যায়; জনগণকে জিম্মি করার কোনো মানে হয় না।”

ধর্মঘটে সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে মোজাম্মেল হক বলেন, “ধর্মঘটের নামে মানুষের মুখে কালি মাখালেও; আজ দেখলাম অনেককে কান ধরে ওঠাবসাও করানো হয়েছে; কিন্তু পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।”

সড়ক পরিবহন আইনের কিছু ধারা সংশোধনের দাবিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট শুরু হয় গতকাল রোববার ভোর ৬টায়। মঙ্গলবার ভোর ৬টায় তা শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

তবে দাবি মানা না হলে আরও কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা আসছে বলে জানিয়েছেন পরিবহন শ্রমিক নেতারা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বেনারকে বলেন, “আগামীকাল থেকে ২১ দিন গণপরিবহন চলাচল করবে। এই সময়ের মধ্যে আমরা সরকারকে আমাদের ৮-দফা দাবির বিষয়ে লিখিত ও মৌখিকভাবে জানানোর চেষ্টা করব। দাবি মেনে না নিলে ২১ দিন পর আবারও ৯৬ ঘণ্টার ধর্মঘটে যাব।

“দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব,” বলেন তিনি।

আইন সংশোধন সম্ভব নয়

সড়ক পরিবহন আইনের যেসব ধারা সংশোধনের দাবি জানানো হয়েছে তা হলো, সড়ক দুর্ঘটনার সব অপরাধ জামিনযোগ্য করা, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান বাতিল করা, সড়ক দুর্ঘটনায় গঠিত যেকোনো তদন্ত কমিটিতে ফেডারেশনের প্রতিনিধি রাখা, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণি নির্ধারণ এবং সড়কে পুলিশের হয়রানি বন্ধ করা।

তবে আইনের এসব ধারা এ মুহূর্তে সংশোধন সম্ভব নয় বলে রোববার সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। রোববার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘শ্রমিক নেতারা আইনটি ভালোভাবে না পড়েই আন্দোলনে নেমেছেন।”

একই দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এই কথা জানিয়ে শ্রমিকদের ধর্মঘট প্রত্যাহারে অনুরোধ করেন।

ধর্মঘটের নামে নৈরাজ্য: শিশুর মৃত্যু, মুখে কালি

আট দফা দাবি ২৭ অক্টোবরের মধ্যে পূরণ না হলে পরদিন থেকে দুদিনের কর্মবিরতিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গত ১২ অক্টোবর নেয় শ্রমিক ফেডারেশন। কর্মবিরতি বা ধর্মঘটের কথা বললেও কার্যত অবরোধ ডেকে নৈরাজ্য করতে দেখা গেছে পরিবহন শ্রমিকদের।

সিলেটের মৌলভীবাজারে শ্রমিকদের বাধার মুখে পড়ে মৃত্যু হয় সাত দিন বয়সী অসুস্থ এক শিশুর। ডাক্তারের পরামর্শে শিশুটির মা ও চাচা মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে সিলেট যাচ্ছিলেন। পথে দুইবার বাধা দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় পথেই শিশুটি মারা যায়।

এছাড়াও রোববার এই ধর্মঘট পালনকালে শ্রমিকরা সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে বেপরোয়া আচরণ করেছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি ও চালকদের পথরোধ করে মবিল মাখিয়ে দিয়েছে। চালক এমনকি শিক্ষার্থীদের শারীরিকভাবে হেনস্তা করার পাশাপাশি গাড়ি থেকে যাত্রীদের নামিয়েও দিয়েছে।

তবে সোমবার এসব ঘটনা ছিল কম। রাজধানীতে পরিবহন শ্রমিকদের পিকেটিং করতে দেখা যায়নি।

চরম দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ

ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনেও চরম দুর্ভোগের শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক যানবাহনের বাইরে কোনো গণপরিবহন দেখা যায়নি। রাজধানীর রাস্তায় হাজার হাজার মানুষকে হাঁটতে দেখা গেছে।

স্কুল, কলেজ, অফিসগামী যাত্রীদের অনেকে রিকশা, ভ্যান, সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা ব্যবহার করে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। সরকারি সংস্থা বিআরটিসির কিছু সংখ্যক বাস চলতে দেখা যায়। তবে তা চাহিদার তুলনায় ছিল খুবই কম।

ধর্মঘটে দূরপাল্লার বাস চলাচল না করায় ঢাকার বাইরে বা ঢাকায় আসতে পারছেন না যাত্রীরা। খুব জরুরি প্রয়োজনে বেশি টাকার বিনিময়ে প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাসে চলাচল করেছেন অনেকে।

কাঁচা বাজারে আগুন

ধর্মঘটের কারণে এক রাতেই রাজধানীর কারওয়ান বাজারে তরকারির মূল্য কয়েকগুণ বেড়ে বিক্রি হতে দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিরাতে যেখানে পাঁচ শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক আসে, সেখানে রোববার রাতে ট্রাক এসেছে মাত্র তিন-চারটি। এর ফলে তরি-তরকারির দাম বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।

পরিবহন ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরেও। পণ্যবাহী কয়েকশ ট্রাক বন্দর টার্মিনালে আটকা পড়েছে। স্থবির হয়ে গেছে বন্দরের কার্যক্রম।

চট্টগ্রাম সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন বাচ্চু বেনারকে বলেন, “চার থেকে পাঁচ হাজার কনটেইনার এ দুদিনে খালাস হতো; কিন্তু তা বন্ধ থাকায় বাজারে এর প্রভাব পড়বে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।