ব্লগার রাজীব হত্যায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রানা ফের পুলিশ রিমান্ডে

ঢাকা থেকে প্রাপ্তি রহমান
2017.02.21
ফাঁসির আসামি রিদওয়ানুল আজাদ রানা। ফাইল ফটো ফাঁসির আসামি রিদওয়ানুল আজাদ রানা। ফাইল ফটো
সৌজন্যে: ঢাকা মহানগর পুলিশ

মালয়েশিয়া থেকে ফেরত পাঠানো রিদওয়ানুল আজাদ রানা ও তার সহযোগী আশরাফকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে আদালত। ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যার দায়ে এর আগে রানাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।

রানার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে নতুন মামলা দিয়েছে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার পুলিশের পক্ষ ​থেকে আদালতকে জানানো হয়, ওই আসামিরা কয়েকজনের সঙ্গে গোপন বৈঠক করছিল। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তিন–চারজন পালিয়ে যায়, দুজন ধরা পড়ে।

আদালত সূত্র জানায়, রানা ও তার সহযোগী আশরাফকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড অনুমোদন করা হয়েছে। রানার আইনজীবী হাফেজ আহাম্মেদ রিমান্ডের বিরোধিতা করে বিচারকের কাছে তার মক্কেলের জামিন চাইলেও শেষমেশ তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের খুঁজে খুঁজে ধারাবাহিকভাবে হত্যার শুরু ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চলা এসব হত্যাকাণ্ডের প্রথম শিকার আহমেদ রাজীব হায়দার। চার বছর পর গত সোমবার আসামি রানা গ্রেপ্তার হয়।

আহমেদ রাজীব হায়দারের বাবা নাজিমউদ্দীন বেনারকে জানান, রানা কীভাবে মালয়েশিয়া পালিয়ে গেল, তা বের করা দরকার।

“আমার খটকা হলো কীভাবে রানা পালাল? মালয়েশীয় পুলিশ ধরিয়ে না দিলে রানা গ্রেপ্তার হতো কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে,” জানান নাজিমউদ্দিন।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, রাজীবকে হত্যার কয়েক মাস পর ২০১৪ সালের শুরুর দিকে রানা মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যায়। সোমবার মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষ রানা ও আশরাফ নামে তাঁর এক সহযোগীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠান।

তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আসছে জেনেও তাকে বিমানবন্দরে আটক না করে কেন যেতে দেয়া হলো এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা পুলিশের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি।

আহমেদ রাজীব হায়দার। ফাইল ফটো।
আহমেদ রাজীব হায়দার। ফাইল ফটো।
বেনারনিউজ
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “গোয়েন্দা পুলিশ শূন্য থেকে শুরু করেছিল। খুনিদের গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী হিসেবে রানার নাম বেরিয়ে আসে। শুধুমাত্র রানা নাম এবং শারীরিক বর্ণনা থেকে তার আসল পরিচয় উদ্‌ঘাটন করা হয়।”

তিনি আরও বলেন, তার আসল পরিচয় উদ্‌ঘাটনের আগেই সে মালয়েশিয়া পালিয়ে যাওয়ায় গ্রেপ্তার করতে সময় লেগেছে। তবে ২০১৪ সালেই তার ছবি ও আনুষঙ্গিক তথ্য মালয়েশীয় পুলিশকে পাঠানো হয়েছিল।

রানা ২০০৫ সালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি ও নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় রানা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তাত্ত্বিক গুরু জসীমউদ্দীন রাহমানীর সংস্পর্শে আসে।

রাজীব ছাড়াও ২০১৫ সালের শুরুর দিকে সংঘটিত বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাও রানা করেছিল বলে ধারণা করছে পুলিশ। এর মধ্যে ২০১৩ সালের শেষভাগে মণিপুরে এক স্কুলশিক্ষক হত্যা চেষ্টায় তার সম্পৃক্ততার কথা জানা গেছে।

পুলিশ বলছে, রানা দেশে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল। তবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পর জুন্নুন শিকদারের সহযোগিতায় রানা আইএসের দিকে ঝুঁকে পড়ে। জুন্নুন এখন সিরিয়ায় আছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে।

পুলিশ আরও জানায়, রানা সিরিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সম্প্রতি সে ফিলিপাইনের আবু সায়াফ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হতে মালয়েশিয়া ছাড়ার চেষ্টা করছিল। তখনই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে।

উচ্চ আদালতের মামলাটি অপেক্ষমাণ

আহমেদ রাজীব হায়দারকে খুনের ঘটনায় ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর আদালত ফয়সাল বিন নাঈম ও রানাকে মৃত্যুদণ্ড, একজনকে যাবজ্জীবন এবং জসীমউদ্দীন রাহমানীসহ পাঁচজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়।

আহমেদ রাজীব হায়দার খুনের দুই সপ্তাহের মধ্যেই আসামিদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছিল পুলিশ। হত্যাকারীদের ওই দলটি ছিল নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি কেন্দ্রিক। আদালতে গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের জবানবন্দি ও পুলিশি তদন্তে রানার নাম প্রধান পরিকল্পক হিসেবে বেরিয়ে আসে।

আদালতে আসামি মো. মাকসুদুল হাসান অনীক ১৬৪ ধারায় যে জবানবন্দি দেন সেখানে রানার ভূমিকা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে। ওই জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ২০১০ সালের শেষ দিকে তার সঙ্গে সেকেন্দার আলী, রানা এবং সাইফ কবিরের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রার্থনা কক্ষে পরিচয় হয়েছিল। ওই দলে ছিল জুন্নুন, রুম্মান, দীপ, নাফিস, সাদমান এবং ইরাদ। তাদের সবাই জিগাতলার হাতিমবাগ মসজিদের ইমাম জসিমউদ্দির রাহমানির খুতবা শুনতে যেত। সেখানে ধর্মীয় আলোচনার পরিবর্তে জিহাদি বিষয়ে কথাবার্তা হতো বেশি।

“রানা ভাইই (রিদওয়ানুল আজাদ) আমাদের ব্লগার রাজীবকে হত্যা করার জন্য বিভিন্নভাবে মোটিভেট করত। রানা আমাদের বলত ইসলাম ও মহানবীর অবমাননাকারী রাজীবকে হত্যা করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব,” জবানবন্দিতে বলেছে মাকুসুদুল।

গণজাগরণ মঞ্চের সন্তুষ্টি ও সংশয়

আহমেদ রাজীব হায়দার ব্লগে ‘থাবা বাবা’ নামে লিখতেন। তিনি ছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক। রানাকে গ্রেপ্তার করায় গতকাল মঙ্গলবার মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার সন্তোষ প্রকাশ করেন।

“ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রানা গ্রেপ্তার হয়েছে, এটা ইতিবাচক। তবে রায় কার্যকরের আগে কিছুই বলা যায় না। এর আগেও আমরা লেখক-ব্লগার-প্রকাশক হত্যার বিচার নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র দেখেছি। আত্মস্বীকৃত খুনিদের জামিন দিয়ে বিদেশ যাওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়েছে। রানার বিচারিক গতি দেখলেই আসল উদ্দেশ্য পরিষ্কার হবে,” বেনারকে বলেন ইমরান।

উল্লেখ্য, রানার বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ। পৈতৃক বাড়ি ফেনির দাগনভূঞার জয় লস্করপুর গ্রামে। সে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় নিজের নাম, জন্ম তারিখ, বাবা-মায়ের নাম অপরিবর্তিত রেখেছিল। কী করে হত্যাকাণ্ডের এক বছর পর পর্যন্ত সে বাংলাদেশে থাকল ও নির্বিঘ্নে দেশ ছেড়ে বেরিয়ে গেল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

কাউন্টার টেররিজমের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলছেন, বিষয়গুলো তাঁরা খতিয়ে দেখছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।