দুই কর্মীকে ধর্ষণ: ঢাকায় পোশাক কর্মীদের বিক্ষোভ

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.01.17
ঢাকা
200117_Rape_Incidents-Bangla_1000.jpg ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভ। ১৭ জানুয়ারি ২০২০।
[বেনারনিউজ]

দুই কর্মী ধর্ষণের ঘটনায় শুক্রবার ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকেরা। দোষীদের আটক ও বিচারের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই সমাবেশ ও মানববন্ধনের আয়োজন করে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার রেশ না কাটতেই গত মঙ্গলবার ঢাকার আশুলিয়া ও ভোলার চরফ্যাশনে এই দুই পোশাক কর্মীকে গণধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পৃথক দুই ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনকে আটক করেছে পুলিশ।

এদিকে বুধবার ঢাকার বংশালে এক পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ওই কিশোরকেও আটক করা হয়েছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতি প্রধান তাসলিমা আক্তার শুক্রবারের সমাবেশে বলেন, “দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণ বেড়ে চলেছে। যদি ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হতো তাহলে ধর্ষণের ঘটনা ঘটত না।”

দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সোমবার জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও বিরোধীদলীয় তিন সাংসদ ধর্ষকদের সরাসরি ‘ক্রসফায়ারে’ মেরে ফেলার দাবি জানিয়েছেন।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেছেন, “সরকার কাউকে বিনা বিচারের হত্যার পক্ষপাতী নয়। অপরাধ করলে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাউকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করে না।”

এ প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “হত্যা করে ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না। ধর্ষণ বন্ধ করতে প্রয়োজন সুশাসন।”

“এখানে ধর্ষণের অন্যতম মূল কারণ হলো নৈতিক অধঃপতন, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, গণতন্ত্রের অভাব ও সুশাসনের অভাব,” বলেন নূর খান।

চরফ্যাশনে গণধর্ষণ

চরফ্যাশন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামসুল আরেফিন বেনারকে বলেন, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে লঞ্চে করে এক নারী তৈরি পোশাক কর্মী (২৩) চরফ্যাশনে তাঁর নিখোঁজ স্বামী মিজানকে খুঁজতে আসেন। তিনি রিকশা চালক নয়নকে (২২) তাঁর শ্বশুর বাড়ির ঠিকানায় নিয়ে যেতে বলেন।

তিনি বলেন, “রিকশা চালক ওই নারীর স্বামীকে চেনার কথা বলে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটি সুপারি বাগানে নিয়ে যায়। এরপর তার সহযোগী স্থানীয় এক মোটরসাইকেল চালক মনিরকে (২২) সাথে নিয়ে ওই নারীকে সেখানে ধর্ষণ করে।”

শামসুল বলেন, “ওই নারী আমাদের থানায় এসে অভিযোগ করলে আমরা তাঁকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়ার সময় পথে নয়নকে পাই। ওই নারী নয়নকে শনাক্ত করেন। এরপর তার দেয়া তথ্য মতে মনিরকে গ্রেপ্তার করি।”

তিনি বলেন, “দুই ধর্ষণকারী আদালতে তাদের অপরাধ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। তারা বলেছে, তারা তাদের কাজের জন্য অনুতপ্ত। আটক দুজনই এখন কারাগারে রয়েছে।”

আশুলিয়ায় গণধর্ষণ

আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “গত মঙ্গলবার এক নারী তৈরি পোশাক কর্মী থানায় আমাদের কাছে অভিযোগ করেন যে, এক মাসের বাসা ভাড়া না দিতে পারায় তার বাড়িওয়ালা তার গলার চেইন খুলে নিয়ে আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে গণধর্ষণ করেছে।”

তিনি বলেন, “আমরা মামলা রুজু করে বাড়িওয়ালাসহ আরেকজনকে গ্রেপ্তার করেছি। আমরা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখছি। ঘটনা প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হবে।”

ধর্ষণের শিকার কত?

বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, ২০১৯ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৪১৩ নারী। ধর্ষণের শিকার যারা তাদের মধ্যে বেশ কিছু শিশু রয়েছে।

ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন।

২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮১৮ জন। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৭৩২ নারী।

গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশে সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারি নামক বেসরকারি সংগঠনের প্রধান কল্পনা আক্তার বেনারকে বলেন, “প্রতি বছর কত সংখ্যক তৈরি পোশাক কর্মী ধর্ষণের শিকার হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া কঠিন। তবে গত কয়েক মাসে সারাদেশে যত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় শতকরা ৪০ ভাগের মতো নারী তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত।”

উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, তার সংগঠন যৌন নিপীড়ন নিয়ে ১৮০ জন নারী কর্মী ও ৩৮ জন পুরুষ কর্মীর সাথে বৈঠক করেছে। এর মধ্যে ৭৫ জন নারী বলেছেন তাঁরা সরাসরি ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার।

কল্পনা আক্তার বলেন, “তৈরি পোশাক শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হলেও তারা কলঙ্কের ভয়ে সে ব্যাপারে কথা বলতে চান না।”

পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ধর্ষক?

বংশাল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রেজাউল ইসলাম বেনারকে বলেন, গত বুধবার বংশাল এলাকায় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রায়হান সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করেছে বলে মেয়ের মা থানায় মামলা করেছেন। আমরা মামলা গ্রহণ করেছি।”

রেজাউল বলেন, “ধর্ষক কিশোরের বাড়ির দোতলায় মেয়ের পরিবার ভাড়া থাকে। মেয়েটির বাবা বঙ্গবাজারে একটি কাপড়ের দোকানে চাকুরি করেন। আর মা প্রাইভেট টিউশনি করতেন।”

তিনি বলেন, “১৫ তারিখ মেয়েটির মা টিউশনি করতে বাইরে ছিলেন। বাসায় বাবা ছিলেন। বাড়ির মালিক মেয়েটির বাবাকে বিদ্যুৎ বিল দিতে বাইরে পাঠান। এই সময়ে মেয়েটি বাসায় একা ছিল। সুযোগ পেয়ে বাড়িওলার নাতি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া রায়হান বাসায় ঢুকে বাচ্চাটিকে ধর্ষণ করে।”

রেজাউল বলেন, “নির্যাতনে মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শিশুটিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঠিয়েছি। মেয়েটি কথা বলতে পারলেও অসুস্থ।”

তিনি বলেন, “আসামি রায়হানের বয়স ১৫ বলা হলেও তার প্রকৃত বয়স ১২ বছর হবে। আমরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা রুজু করেছি। রায়হানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”

তবে তার বিচার শিশু আদালতে হবে বলে জানান রেজাউল ইসলাম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।