বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলায় অবশেষে দুই আসামি গ্রেপ্তার

প্রাপ্তি রহমান
2017.05.12
ঢাকা
প্রধান আসামি শাফাত আহমেদ ও তিন নম্বর আসামি সাদমান সাকিফকে আদালতে হাজির করা হয়। প্রধান আসামি শাফাত আহমেদ ও তিন নম্বর আসামি সাদমান সাকিফকে আদালতে হাজির করা হয়। মে ১২, ২০১৭।
ফোকাস বাংলা

ঘটনার সূত্রপাত বনানী থানায় গত ৫ মে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের অভিযোগ করছেন, পুলিশ মামলা নিচ্ছে না। প্রধান আসামি দেশের শীর্ষ স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ছেলে। সংবাদমাধ্যমে এই খবর প্রচারের পর পুলিশ মামলা নেয়। নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো, অনলাইনের প্রতিবাদ সমাবেশে গড়ায়। কিন্তু আসামি আর ধরা পড়ে না। সুবিচার পাওয়া নিয়ে নতুন করে সংশয় শুরু হয়।

অবশেষে মামলা দায়েরের ছয় দিন পর গত বৃহস্পতিবার সিলেট থেকে পুলিশের চারটি বিভাগের একটি সমন্বিত দল প্রধান আসামি শাফাত আহমেদ ও তিন নম্বর আসামি সাদমান সাকিফকে গ্রেপ্তার করে। শাফাত আহমেদের বাবা আপন জুয়েলার্স এর অন্যতম স্বত্বাধিকারী।

সাদমান সাকিফ রেগনাম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হোসেন জনির ছেলে। সাদমান নিজেও এই গ্রুপের একজন পরিচালক।

এজাহারভুক্ত অন্য তিন আসামি এখনো গ্রেপ্তার হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণ ঘটনা নিয়ে মারাত্মক ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছিল পুলিশ বাহিনী। দুই আসামি গ্রেপ্তারের পর শুক্রবার ঢাকা মহানগর পুলিশ মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। ওই সংবাদ সম্মেলনে জয়েন্ট কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় প্রতিশ্রুতি দেন, পুলিশ সব অনুরাগ–বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করবে, সুবিচার নিশ্চিত করতে যা যা করতে হবে তা–ই করবে।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের অভিযোগ

মামলার এজাহারে ধর্ষণের শিকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বলেন, ২৮ মার্চ রাতে বনানীর রেইন ট্রি হোটেল ও রেস্টুরেন্টে তাঁরা নির্যাতনের শিকার হন। এক নম্বর আসামি শাফাত আহমেদ ওই দিন তাঁদের জন্মদিনের পার্টিতে দাওয়াত করেছিলেন। বলেছিলেন বাদী যতজনকে চান, ততজন বন্ধুকে নিয়েই পার্টিতে আসতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তাঁর দুজন মেয়ে বন্ধু ও একজন ছেলে বন্ধুকে নিয়ে পার্টিতে হাজির হন।

পার্টি শেষ হওয়ার পর শাফাত আহমেদ ও তাঁর বন্ধু নাঈম আশরাফ ওদের গাড়ির চাবি ছিনিয়ে নেয়। শাফাতের দেহরক্ষী মাথায় পিস্তল ঠেকায়। তারপর হোটেলের দুটি কক্ষে তাদের উপর্যুপরি ধর্ষণ করে শাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ। ধর্ষণের সময় শাফাত আহমেদ তার গাড়ি চালক বিল্লালকে দিয়ে পুরো ঘটনার ভিডিও করায়।

বনানী থানায় এই অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার পর পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল মতিনের প্রশ্ন ছিল, ২৮ মার্চের ঘটনা, অভিযোগ দায়েরে এত দেরি কেন। তাঁর আরেকটি প্রশ্ন ছিল, ছাত্রীরা শাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহাবুবাকে সঙ্গে এনেছে কেন। এ দুটো প্রশ্নের সদুত্তর পেলে তবেই তিনি মামলা নেবেন।

শাফাত আহমেদের বাবা দিলদার আহমেদ ও সাদমান সাকিফের বাবা মোহাম্মদ হোসেন জনি দুজনেই দাবি করেন তাঁদের ছেলেরা নির্দোষ। তাঁরা চক্রান্তের শিকার।

বিষয়টির বিস্তারিত বিবরণ সংবাদমাধ্যমগুলোয় ছাপা হয়।

এ নিয়ে বাদীর বক্তব্য ছিল, মামলার তিন নম্বর আসামি সাদমান সাকিফের মাধ্যমে শাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় হয় ধর্ষণের ঘটনার দিন ১৫ আগে। তাঁদের প্রতি নির্যাতনের বিচার চাইবেন বাদীর এমন কথায় সাদমান সাকিফ তাদের চুপ করে যেতে বলেন। বাদী ফেসবুক থেকে শাফাত আহমেদের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহাবুবকে খুঁজে বের করে নালিশ করেন। এর কিছুদিন পর শাফাত আহমেদের দেহরক্ষী বাদীর বাড়ির সামনে ঘোরাফেরা করতে শুরু করে।

“শাফাতের দেহরক্ষীকে বাড়ির সামনে ঘোরাফেরা করতে দেখে আমরা ভয় পেয়ে যাই। শাফাত বলেছিল, তার কথা মতো না চললে ভিডিও প্রকাশ করে দেবে। আমরা বাসায় কথাগুলো বলতে পারিনি। তাই শাফাতের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে থানায় যাই। এর পেছনে আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না,” বাদী বেনারকে বলেন।

দ্য রেইন ট্রিতে যোগাযোগ করে জানা যায়, ২৮ মার্চ জন্মদিনের পার্টি হয়েছিল। তবে ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে তাঁদের জানা নেই।

“শাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফের নামে হোটেলর দুটি কক্ষ ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। পরদিন সকালে তাঁরা চেক আউট করেন। ওই দুটি কক্ষে আরও কেউ ছিল কি না আমরা জানি না। অস্বাভাবিক কিছু আমাদের চোখে পড়েনি,” দ্য রেইন ট্রির মহাব্যবস্থাপক ফ্র্যাঙ্ক ফরগেট বেনারকে বলেন।

৪৮ ঘণ্টার চেষ্টায় মামলা

থানায় অভিযোগ দায়ের করতে যাওয়ার দুদিন পর শিক্ষার্থী দুজন মামলা দায়ের করতে পারেন। তারপর আসামি গ্রেপ্তারে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক পুলিশ বাহিনী থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। পুলিশ আসামি গ্রেপ্তারে সর্বাত্মক অভিযান চালাচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গোপনীয়) মনিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “আসামি গ্রেপ্তার ছিল পুলিশের এক নম্বর কাজ। চেষ্টা চলছিল। অবশেষে একটা সফলতা পাওয়া গেছে।”

“বনানী থানা, উইমেন সাপোর্ট সেন্টার, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের পর বুধবার পুলিশ সদর দপ্তর অভিযানে যুক্ত হয়। পরে সিলেটের মদিনা মার্কেট এলাকার একটি বাসা থেকে দুই আসামি গ্রেপ্তার হয়। এটা নিয়ে অনেক আলোচনা–সমালোচনা হয়েছে। তবে পুলিশ আন্তরিক ছিল,” মনিরুজ্জামান বলেন।

গতকাল শুক্রবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জয়েন্ট কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন বনানী থানার ভূমিকা খতিয়ে দেখতে কমিটি করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, পুলিশ সব অনুরাগ–বিরাগের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করছে, করবে। তিনি আশা করেন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যে ‘ভুল বোঝাবুঝি’, মানুষের মধ্যে পুলিশের প্রতি যে অবিশ্বাস তা দূর হবে।

শুক্রবার বিকাল তিনটার দিকে আসামিদের ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। এসময় পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জামিনের আবেদন করেন। শুনানির পর মহানগর হাকিম রায়হান উল ইসলাম শাফাতকে ৬ দিনের ও সাদমানকে ৫ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।