বৈষম্যমূলক আইনে বাধাগ্রস্ত ধর্ষণের বিচার

প্রাপ্তি রহমান
2017.05.31
ঢাকা
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বনানীর একটি হোটেলে ছাত্রী ধর্ষণ ঘটনার বিচার দাবিতে মহিলা গণফোরামের মানববন্ধন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বনানীর একটি হোটেলে ছাত্রী ধর্ষণ ঘটনার বিচার দাবিতে মহিলা গণফোরামের মানববন্ধন। মে ১৬, ২০১৭
নিউজরুম ফটো

বিতর্কিত ‘টু ফিঙ্গার্স টেস্ট’ ও দেড় শ বছরের পুরোনো সাক্ষ্য আইনে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ধারা বলবৎ থাকায় ধর্ষণের শিকার নারীরা বিচারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠনগুলো মনে করে বৈষম্যমূলক বিচারিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তন হওয়া সময়ের দাবি।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, যাঁরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন তাঁরা মামলা করছেন না। মামলা করলেও শেষ পর্যন্ত লড়ে যাচ্ছেন খুব কমসংখ্যক নারী। সমাজ ও বিচারব্যবস্থা যথেষ্ট অনুকূল না হওয়ায় এমনটা ঘটছে বলে মনে করেন তাঁরা।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর দুই আঙুলের মাধ্যমে ধর্ষণ পরীক্ষা পদ্ধতির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মানবাধিকার ও বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক), মহিলা পরিষদ, ব্র্যাক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও নারী পক্ষ এবং দুই চিকিৎসক রিট আবেদন করেন।

এর প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের নির্দেশে স্বাস্থ্য সচিবকে প্রধান করে গঠিত কমিটি টু ফিঙ্গার্স টেস্টের বিকল্প একটি নীতিমালা তৈরি করে জমা দেয়।

“রিটের ওপর এখনো আদালত কোনো রায় দেয়নি। রিট আবেদনের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বিভিন্ন পক্ষের সদস্যদের নিয়ে একটি কমিটি হয়েছিল। কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আদালতের নির্দেশে সেটির রিভিউও শেষ হয়। এখন আমরা আদালতের দিকে তাকিয়ে আছি,” বেনারকে বলেন (ব্লাস্ট) এর কর্মকর্তা মাহবুবা আক্তার।

“হাইকোর্টের এই রায়ের ওপরই নির্ভর করছে টু ফিঙ্গার্স টেস্ট থাকবে কি থাকবে না,” জানান তিনি।

ব্লাস্ট ও অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো এখন সাক্ষ্য আইনের বৈষম্যমূলক ধারাটি বাতিলের জন্য রিটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা আইন কমিশনের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে।

কেন বৈষম্যমূলক

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা শুভ্রা ‘সতীরাই কেবল ধর্ষণ হয়’ শিরোনামে গবেষণা করেন। টু ফিঙ্গার্স টেস্ট কেন বৈষম্যমূলক বোঝাতে গিয়ে তিনি প্রক্রিয়াটির বর্ণনা দেন বেনারকে।

ফাতেমা শুভ্রা বলছিলেন, এই প্রক্রিয়ায় চিকিৎসকেরা ধর্ষণের শিকার নারীর যোনিপথে আঙুল ঢোকান। তাঁরা নারীর যোনিপথের ঘনত্ব পরিমাপ করে, তাঁর হাইমেনের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি নির্ধারণ করেন। হাইমেনকে ধরা হয় একটি ঘড়ির ফ্রেম হিসেবে। ঘড়ির কাঁটার ৩ বা ১০ এর অবস্থানে যদি হাইমেন ছেঁড়া থাকে তাহলে চিকিৎসকেরা ধরে নেন, ধর্ষণ হয়নি। সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক হয়েছে। ঘড়ির কাটার ৫ বা ৮ এর দিকে ছিঁড়লে ধরে নেন জোরাজুরি হয়েছে।

“সব বয়সের নারীই ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু আমরা বিচার করতে গিয়ে একটা পুরুষালি পথে হাঁটছি। নানা কারণে হাইমেন নাও থাকতে পারে। তাই টু ফিঙ্গার্স টেস্ট কেন লাগবে, বোধগম্য নয়,” ফাতেমা শুভ্রা বলেন।

এই পদ্ধতির দরকার আছে কি না—জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকো লিগ্যাল সোসাইটির সভাপতি এ এম সেলিম রেজা বলেন, “টু ফিঙ্গার্স টেস্টের কোনো প্রয়োজন আমি দেখি না। খুব বেশি প্রয়োজন পড়লে ভ্যাজাইনাল স্পেকুলাম নামের একটি যন্ত্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা যেতে পারে। আর সেই কাজটা ফরেনসিক মেডিসিনের পুরুষ ডাক্তারদের পরিবর্তে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের দিয়ে করানো উচিত,” বেনারকে বলেন সেলিম রেজা।

বাংলাদেশের আইনে টু ফিঙ্গার্স টেস্ট থাকলেও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই টেস্ট বাতিল করেছে। গত বছরের ২ নভেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য ‘টু ফিঙ্গার্স টেস্ট’ এর বিকল্প স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রদানের নির্দেশ দেন।

বিচারপতি বি এস চৌহান ও এফ এম কালিফুল্লাহর পর্যবেক্ষণ ছিল, টু ফিঙ্গার্স টেস্ট এবং এর যে ব্যাখ্যা তা ধর্ষণের শিকার একজন নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার ও সম্মান ক্ষুণ্ন করে।

স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ধর্ষণের শিকার নারী টু ফিঙ্গার্স টেস্ট পার হয়ে যখন বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়েন, তখন তাঁকে ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারার মুখোমুখি হতে হয়।

“আইনে ধর্ষণের অভিযোগকারী বা ধর্ষিত নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ধর্ষককে দেওয়া হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে যখন ধর্ষণ বা বলাৎকার করার চেষ্টার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হয়, তখন দেখানো যেতে পারে যে, অভিযোগকারী নারী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রের,” বেনারকে বলেন সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ফাহিমা নাসরিন।

তিনি আরও বলেন, আসামিপক্ষ সব সময় এই ধারার সুযোগ নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগকারীকে বারবার আদালত ভর্তি লোকের সামনে ধর্ষণের ঘটনা বলতে বাধ্য করেন।

নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক এই ধারাটিও ২০০২ সালে ভারত সংশোধন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো রয়ে গেছে।

সরকার পক্ষের কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বেনারকে বলছিলেন, “ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে, সতীত্বের প্রশ্ন এসে যায়। এই অভিযোগ গুরুতর। মিথ্যা মামলাও হচ্ছে।”

বিচারের চিত্র

ঢাকা মহানগর এলাকার জন্য পাঁচটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আছে।

আদালত সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগর এলাকায় গত ১৫ বছরে দায়ের হওয়া ৪ হাজার ৪৩৬টি ধর্ষণ মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ২ হাজার ৫৭টি। তবে এর মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র মাত্র ২২টি ঘটনায়।

পুলিশ সদর দপ্তরের মনিটরিং সেলের তথ্য মতে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন থানায় ১৮ হাজার ৬৬৮টি ধর্ষণ মামলা দায়ের হয়। এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ধর্ষণের মামলা হয়েছে ১ হাজার ১২৬ টি। তবে এর মধ্যে কতটি ঘটনার নিষ্পত্তি হয়েছে সে তথ্য পাওয়া যায়নি।

ধর্ষণের শিকার এক নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলছিলেন, মামলা দায়ের করা থেকে যেভাবে তিনি হেনস্তা হয়েছেন, মামলা করে ভুল করেছেন কি না তা-ই ভাবছেন। তিনি আরও বলছিলেন, ঢাকার একটি থানায় মামলা দায়েরের পর এজাহারের অনুলিপিও তিনি পাননি। কিন্তু থানা তাঁর নাম ঠিকানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম সবাইকে বলে দিয়েছে।

“আত্মীয়-স্বজনেরা আমাকে বোঝা ভাবছেন। বিচার হওয়া পর্যন্ত সবার সমর্থন পাবো কি না তাই ভাবছি।”

নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকারের মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম এর পরিচালক আবুল হোসেন বলছিলেন, ধর্ষণের দায় নারীর ওপর চাপানো বন্ধ করলেই বিচারের হার বাড়বে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।