জিনের ভয় দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে মসজিদের ইমাম গ্রেপ্তার

প্রাপ্তি রহমান
2019.07.22
ঢাকা
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
190722_cleric_arrested_1000.jpg জিনের ভয় দেখিয়ে নারী ও শিশু ধর্ষণের অভিযোগে দক্ষিণখান এলাকার একটি মসজিদের ইমাম ইদ্রিস আহম্মেদকে গ্রেপ্তারের পর মিডিয়া সেন্টারে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে র‍্যাব। ২২ জুলাই ২০১৯।
[ফোকাস বাংলা]

একাধিক ধর্ষণ ও বলাৎকারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার একটি মসজিদের ইমাম ইদ্রিস আহম্মেদ (৪২) গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন—র‍্যাব। তিনি মসজিদে নামাজ পড়ানোর পাশাপাশি একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন।

“দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে এলাকার মসজিদে ইমামতি ও মাদ্রাসার শিক্ষকতাকে কাজে লাগিয়ে একাধিক নারীকে ধর্ষণ ও শিশু–কিশোরদের বলাৎকার করতেন ইদ্রিস আহম্মেদ। কেউ প্রতিবাদ করলে জিনের ভয় দেখিয়ে তাকে দমিয়ে রাখতেন,” সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান র‍্যাব-১ এর পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম।

সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মিডিয়া সেন্টারে ওই ইমামের বিভিন্ন অপকর্মের তথ্য তুলে ধরে র‍্যাব। র‍্যাবের দাবি, ইদ্রিস জিন দিয়ে ভয় দেখানোর সত্যতা স্বীকার করেছেন।

র‍্যাব জানায়, ধর্ষণ ও বলাৎকারের দৃশ্য মুঠোফোনে ভিডিও করে ভুক্তভোগীদের জিম্মি করত ওই ব্যক্তি। এরপর তাঁদের শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করা হতো।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ছয় মাসে বাংলাদেশে ৩৯৯জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে বলে জানাচ্ছে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত সংগঠনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্ষণের পর একজন ছেলে শিশুসহ মোট ১৬টি শিশু মারা গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে কন্যাশিশু ছাড়াও কিশোরদের ওপরও যৌন নির্যাতন হচ্ছে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের হিসেবে, গত ছয় মাসে অন্তত ৪৯টি শিশু (৪৭ জন মেয়েশিশু ও ২ জন ছেলেশিশু) যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। ছয়টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত ৪০৮টি সংবাদ বিশ্লেষণ করে ফাউন্ডেশন এই তথ্য পেয়েছে।

কে এই ইদ্রিস?

ইদ্রিসের বাড়ি সিলেটে। সেখানকার একটি মাদ্রাসা থেকে তিনি ১৯৯৮ সালে টাইটেল পাস করেন। এরপর তিনি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের একটি মসজিদে ইমামতি এবং পাশাপাশি একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন।

২০০২ সালে ঢাকায় এসে দক্ষিণখানে এই মসজিদের ইমাম হিসেবে নিযুক্ত হন। প্রায় দেড় যুগের বেশি সময় ধরে তিনি ওই মসজিদে ইমামতি করছেন।

র‍্যাবের পরিচালক সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, “এই ইমাম এলাকায় এতটাই প্রভাবশালী যে, তাঁকে গ্রেপ্তার করে আনার সময় স্থানীয়দের বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু যখন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে তাঁর নানা অপকর্মের প্রমাণসহ তুলে ধরা হয় তখন তারাই অবাক হয়েছে।”

“কেউ কেউ চিৎকার করে কেঁদে বলেছেন যে, কার পেছনে এত দিন নামাজ পড়লাম?”

র‍্যাব-১ এর অধিনায়ক বলেন, ওই ইমাম এলাকায় প্রচার করেছিলেন যে, তার কাছে জিন আছে। জিন দিয়ে রোগ সারানো হয়। এমন তথ্য প্রচার হওয়ার পর এলাকার নারীরা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য তার কাছে যেতে শুরু করে। আর এ সুযোগে তিনি চিকিৎসার জন্য আসা নারীদের জিনের ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করতেন।

ইদ্রিস আহম্মেদ নিজে ধর্ষণ করতেন, সেই দৃশ্য ভিডিও করাতেন। আবার সহযোগীকে দিয়েও ধর্ষণ করাতেন। এর ফলে যে ভিডিও করেছে সে বাইরে কারও কাছে কিছু বলা বা অভিযোগ করার সাহস পেত না।

সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, ঠিক কয়জন নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে সেটির সুনির্দিষ্ট সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে চার-পাঁচজন নারীকে একাধিকবার ধর্ষণের ভিডিও ইদ্রিস আহম্মেদের মুঠোফোনে পাওয়া গেছে।

“এসব নারীরা সামাজিক অবস্থান ও মানসম্মানের ভয়ে কারও কাছে কোনো অভিযোগ করার সাহস পাননি,” মনে করেন সারওয়ার।

ধর্ষক ইদ্রিস মসজিদের পাশাপাশি ওই মসজিদের মাদ্রাসায়ও শিক্ষকতা করতেন। মাদ্রাসায় পড়তে আসা ১০-১২ বছরের কমপক্ষে ১২ জন শিশুকে তিনি বারবার বলাৎকার করার কথা স্বীকার করেন।

গ্রেপ্তারের পর মসজিদের খাদেমরা ইমামের কাছে নারী ও কিশোরদের জিম্মি হওয়ার বিষয়ে মুখ খুলেছেন।

ইদ্রিস মসজিদের একটি বিশেষ কক্ষে ঘুমাতেন। তার সব অপকর্ম ওই কক্ষেই সম্পন্ন হতো। যেসব নারী একবার তার অপকর্মের শিকার হওয়ার পর আর তাঁর কাছে যেতে চাইতেন না, তাদের তিনি জিন দিয়ে ক্ষতি করার ভয় দেখাতেন, আবারও ডেকে আনতেন।

আবার যেসব শিশু বা শিক্ষার্থী তাঁর নির্যাতনের পর আর পড়তে যেতে চাইত না, তাদের অভিভাবকদেরও জিনের ভয় দেখানো হতো।

শিশু ধর্ষণের ঘটনা আংশকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম এক বিবৃতিতে অভিভাবক, শিশু সংগঠন, মানবাধিকার সংস্থা ও তরুণদের সম্মিলিতভাবে এই অপরাধ ঠেকাতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে দেওয়া ওই বিবৃতিতে তিনি বলেন, এসব ঘটনা যখন শিশুদের নিজ আবাসের একেবারে আশপাশে এবং নিজ চত্বরে ঘটে, তখন তা বাড়তি উদ্বেগের কারণ।

ছেলে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন উপেক্ষিত

বাংলাদেশে ছেলে শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও, অনেক সময় বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়। পুলিশ সদরদপ্তর কিংবা শিশু নির্যাতন রোধে সরকারের মাল্টি সেক্টরাল প্রগ্রাম কারও কাছেই এ বিষয়ে আলাদা কোনো রেকর্ড নেই।

মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রধান আবুল হোসেনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল।

“অনেক ক্ষেত্রেই ছেলে শিশুর পরিবার নিজ উদ্যোগে শিশুকে হাসপাতালে আনেন এবং চিকিৎসা শেষে ফিরিয়ে নিয়ে যান। আইনগত ব্যবস্থাও কতটা কী নিয়ে থাকেন সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই,” আবুল হোসেন বেনারনিউজকে বলেন।

এ বিষয়ে পুলিশ সদরদপ্তরে যোগাযোগ করা হলে কর্মকর্তারা জানান, ছেলে শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। মামলা নেওয়া হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। নির্যাতিত শিশুদের কতজন ছেলে শিশু এবং তাদের কতজন সুবিচার পেল সে সম্পর্কিত তথ্য রাখা হয় না।

তবে বেশ কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ছেলে শিশুদের নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টিও নজরদারির আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।