পশ্চিমবঙ্গের আপত্তিতে গঙ্গা ব্যারেজ করতে পারছে না বাংলাদেশ ও ভারত

কামরান রেজা চৌধুরী ও পরিতোষ পাল
2017.03.02
ঢাকা, কলকাতা
তিস্তা ব্যারেজের নিচে শুকিয়ে যাওয়া নদী। তিস্তা সেতুর নিচে শুকিয়ে যাওয়া নদী। ফেব্রুয়ারি ২০১৭।
ছবি: আতিক রহমান

দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সমর্থনের অভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছে না বাংলাদেশ। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সম্মত হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই ব্যারেজ নির্মাণ করতে চায় না।

ভারতের ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার ভাটিতে বাংলাদেশের রাজবাড়ি জেলার পাংশায় গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে চার বছর আগে। এরপর থেকে বিষয়টি নিয়ে টানাপোড়েন চলছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, ভারতকে গঙ্গা ব্যারেজ সম্পর্কিত সকল কাগজ সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া গত বছর অক্টোবর মাসে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ভ্রমণ করে ব্যারেজের ডিজাইনসহ বিস্তারিত কারিগরি দিক নিয়ে আলোচনা করে গেছেন। কিন্তু এরপর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে আর কিছুই জানানো হয়নি।

“তারা (ভারতীয় দল) প্রকল্পটি দুই দেশের জন্যই উপকারী বলে একমত পোষণ করে গেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো জবাব পাইনি,” বেনারকে বলেন গঙ্গা ব্যারেজ সমীক্ষা প্রকল্পের প্রকল্প প্রধান ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোতাহার হোসেন।

বাংলাদেশে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, সুন্দরবন এবং ভারতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কিছু নদীতে পানির প্রবাহ বাড়বে।

উল্লেখ্য, যৌথ-নদী গঙ্গার ভাটিতে বাংলাদেশ অবস্থিত। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের উজানে পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা পয়েন্টে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করা হয়। এরপর ভাটিতে গঙ্গা নদীর পানি ঘাটতি দেখা দেয়।

সরকারি তথ্য অনুসারে, ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৪০০ কিউসেক। ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে একই পয়েন্টে পানির পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র নয় হাজার ৬৯৮ কিউসেক।

“ভারত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকগুলোতে একমত ছিল যে, বাংলাদেশ পানির ব্যবহার করতে পারে না। ওপর থেকে আসা পানি সমুদ্রে চলে যায়। এখন আমরা পানি ব্যবহারে জন্য ব্যারেজ করতে চেষ্টা করছি। কিন্তু তাদের সমর্থন পাচ্ছি না,” বলেন মোতাহার হোসেন।

তবে তিনি আশা করেন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বুঝিয়ে গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে।

বেনারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সেচ ও জলপথ বিভাগের সচিব কৌশিক চট্টোপাধ্যায় প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারেজ চুক্তি নিয়ে এই মুহূর্তে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

তবে বিশিষ্ট নদী ও পরিবেশ বিজ্ঞানী জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বেনারকে জানিয়েছেন, “গঙ্গার মতো বর্ষার জলে পুষ্ট হিমালয়ের নদীগুলোতে বড় কোনও ব্যারেজ তৈরি করার আগে তার পরিবেশগত দিকটি বিশেষভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। কারণ এই ধরনের ব্যারেজের ক্ষেত্রে উজানের দিকে বিপদের সম্ভাবনা থেকেই যায়। বিশেষ করে পলি জমে নদী ভাঙনের মত সমস্যা দেখা দিতে পারে।”

“গঙ্গা ব্যারেজ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে পানি সমস্যার একটি বিরাট সমাধান হবে। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কিছু নদীতে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশের পরিবেশবিদ ও পানি বিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাত।

তিনি আরও বলেন, ব্যারেজটি গঙ্গা নদীর ভাটিতে বাংলাদেশের পাংশা পয়েন্টে নির্মিত হবে। শুষ্ক মৌসুমের জন্য এই ব্যারেজের সংরক্ষণগারে পানি সঞ্চিত থাকবে। একই সঙ্গে নদীতে মাছ উৎপাদনও বাড়বে।

“তাই বাংলাদেশের উচিত কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে গঙ্গা ব্যারেজ বাস্তবায়ন করা,” মনে করেন আইনুন নিশাত।

বাংলাদেশ–ভারত যৌথ নদী কমিশনের একজন কর্মকর্তা বেনারকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা গত মাসে ভারত সরকারকে গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ সম্পর্কে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠান। কিন্তু ভারত এখন পর্যন্ত কিছু জানায়নি।

ভারতের সংবিধান অনুযায়ী পানির বিষয়টি রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিষয়। সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার মতামত না দিলে কেন্দ্রীয় সরকার পানি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারে না।

এর আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতার মুখে ২০১১ সালে সব কিছু ঠিক থাকার পরও তিস্তা চুক্তি সই হয়নি। এখন পর্যন্ত বিষয়টি ঝুলে আছে।

বাংলাদেশের প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পেও আপত্তি জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প নিয়ে রাজ্যের অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছেন।

প্রশাসনের এক উচ্চ আধিকারিক নাম প্রকাশ না করার সুত্রে জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশ ভারত সরকারকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গকে বন্যা ও ভাঙনের মুখে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশকে ব্যারেজ নির্মাণের অনুমতি দেওয়া যাবে না। এমনকি এ নিয়ে দুই দেশের আলোচনার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থাকবে না।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার প্রস্তাবিত ব্যারেজ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একমত হলেও পশ্চিমবঙ্গ মনে করছে এতে ভালোর চেয়ে মন্দই হবে বেশি। বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বেশ কয়েকজন নদী বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছেন। এরপর তিনি নেতিবাচক এই সিদ্ধান্তে এসেছেন বলে জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পাংশায় বাঁধ হলে গঙ্গায় জল যে বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই জলের ব্যবহারিক নিয়ন্ত্রণ পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের হাতে থাকবে না।

ফলে একদিকে জল বেশি জমা হলে যেমন আশপাশের এলাকা প্লাবিত হতে পারে, তেমনই হঠাৎ বাংলাদেশ তাদের বাঁধ থেকে জল ছাড়লে গঙ্গার জল কমে যাবে।

এ প্রসঙ্গে মোতাহার হোসেন বলেন, “বন্যা হলে তো আগে বাংলাদেশে হবে। তারপর ভারতে। আমরা কি আমাদের দেশে বন্যা সৃষ্টির জন্য গঙ্গা ব্যারেজ করব?”

প্রকল্পের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে সমীক্ষার জন্য গত অক্টোবরে এক বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে জয়েন্ট টেকনিক্যাল সাব-গ্রুপ তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। তাতে পশ্চিমবঙ্গের একজন প্রতিনিধি রাখার কথাও হয়।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর তরফ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কমিটিতে তারা কোনো প্রতিনিধি পাঠাবেন না।

ভারতের জলসম্পদ সচিব অমরজিৎ সিংহ দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই প্রকল্প বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য কেন্দ্রীয় বিশেষজ্ঞ পাঠাতেও চেয়েছিলেন। সেই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছেন মমতা।

কেন্দ্রীয় জলসম্পদ সচিবকে চিঠিতে মুখ্যসচিব লিখেছেন, ওই প্রকল্প নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ এখন পর্যন্ত অন্ধকারে। তাই জয়েন্ট টেকনিক্যাল সাব গ্রুপে রাজ্যের অংশ নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।

বাংলাদেশে পদ্মার ওপর একটি বাঁধ ও জলাধার নির্মাণের বিষয়ে শেখ হাসিনার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে তিস্তার মতো এ ক্ষেত্রেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে মোদী সরকার এগোতে পারছে না।

আগামী এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।