খাদ্য সহায়তা বাড়ায় রোহিঙ্গারা খুশি, তবে দুশ্চিন্তার কারণ দ্রব্যমূল্য
2024.01.05
ঢাকা ও কক্সবাজার
খাদ্য সহায়তা বাড়ায় খুশি হলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।
রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা ঘাটতির কারণে গত বছরের মার্চে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) শরণার্থীদের মাথাপিছু মাসিক বরাদ্দ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করে, জুনে তা আরো কমিয়ে আট ডলার করা হয়।
চলতি বছরের শুরুতে খাদ্যসহায়তা বাড়িয়ে আবার ১০ ডলার করার ঘোষণা দেয়া হয়। এর ফলে শরণার্থীদের সংকট “কিছুটা কমবে” বলে শুক্রবার বেনারকে জানান অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা।
তিনি জানান, চলতি বছরের খরচ মেটাতে ১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য চাওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে এখনো ৬১ মিলিয়ন ডলার ঘাটতি রয়েছে।
দাতাদের অর্থে রোহিঙ্গাদের চাল, ডাল, তেল, আলু, রসুন ও মশলাসহ ১৯টি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ করে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)।
‘রেশনে চলে না’
খাদ্য সহায়তা বাড়ায় খুশি হলেও দ্রব্যমূল্য বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে বেনারকে জানান শরণার্থীরা।
“দুই ডলার সহায়তা বাড়ায় আমরা অবশ্যই খুশি কিন্তু যেভাবে বাজারে সব পণ্যের দাম বাড়ছে, তাতে আমাদের কষ্টের জীবনে আসলে ক্রমাগত কষ্টই যোগ হচ্ছে,” বেনারকে বলেন রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা খিন মং।
বরাদ্দ রেশনের পরিমাণ যথেষ্ট না হওয়ায় সংসার চালাতে কাজের জন্য “রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না” বলে জানান তিনি।
“বিশেষ করে নারী ও শিশুদের খাবার নিয়ে অনেক রোহিঙ্গা পরিবার দুশ্চিন্তায় আছে। উন্নত জীবনের আশায় অনেকে সাগরপথে ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছে,” বলেন খিন মং।
দুর্ঘটনার শিকার হয়ে গত দুই বছর ধরে ঘরবন্দি দিল মোহাম্মদ পরিবারের আট সদস্য নিয়ে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে বাস করেন। তিনি বেনারকে বলেন, “ছয় বছর বাংলাদেশে পার হলো, এক টুকরো মাংস দিয়ে এখনো খাবার খেতে পারেনি।”
“যতটুকু রেশন পাই, তা নিয়ে কষ্টে সংসার চলত। একটু ভালো থাকার আশায় ক্যাম্পের বাইরে কাজ করতে গিয়ে পা ভেঙে যায়। এখন কাজ করাও সম্ভব না।”
“গত বছর দুই দফায় রেশন কমিয়ে দেওয়ায় খাবারের খুব কষ্ট হয়েছে। এখন শুনেছি দুই ডলার বাড়িয়েছে, এটি আমাদের জন্য আনন্দের খবর,” বলেন দিল মোহাম্মদ।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধ্যের বাইরে চলে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বাচ্চাদের নিয়ে আমরা বেশি কষ্টে আছি। আমরা আশা করছি, আমাদের কষ্টের কথা ভেবে আগের মতো ১২ ডলার রেশন দেওয়ার চিন্তা করবে তারা।”
রোহিঙ্গা নারী বেগম নূর নাহারও বেনারকে জানান বর্তমান রেশন দিয়ে সংসার না চলার কথা।
তিনি বলেন, “আমরা যে রেশন পাই তা দিয়ে চলে না। বাচ্চাদের খাওয়ানোর মতো বিশেষ কোনো খাবার থাকে না। দুধের বদলে চালের গুঁড়া গুলিয়ে খাওয়াচ্ছি; এর চেয়ে কষ্টের আর কী থাকতে পারে!”
পর্যাপ্ত পরিমাণ রেশন পেলে রোহিঙ্গাদের শিবির থেকে বের হওয়ার প্রবণতা কমার পাশাপাশি ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে বাংলাদেশ ছাড়ার চেষ্টা কমবে বলে বেনারকে জানান আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. জোবায়ের।
বেনারের পক্ষ থেকে ইউএনএইচসিআর ও ডব্লিউএফপির সঙ্গে যোগাযোগ করে শিশুদের খাদ্য ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সংস্থা দুটি কোনো মন্তব্য করতে চায়নি।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজার পরিস্থিতির কারণে “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি রোহিঙ্গাদের দিক থেকে সরে গেছে,” বলে বেনারকে বলেন শরণার্থী ও অভিবাসন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর।
রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা দুই ডলার বাড়াকে “ইতিবাচক” হিসেব আখ্যায়িত করে এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, সহায়তা আরও না বাড়লে শরণার্থী শিবিরে “নানা সহিংস কর্মকাণ্ড বাড়তেই থাকবে।”
খাদ্য সহায়তায় যুক্ত হচ্ছে পুষ্টিযুক্ত চাল
খাদ্য সহায়তায় বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি ডব্লিউএফপি ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য পুষ্টিযুক্ত চাল (ফর্টিফায়েড রাইস) বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী শুরুতে একটি বা দুটি শিবিরে এই কার্যক্রম শুরু করা হবে। পরবর্তীতে কক্সবাজার ও ভাসানচরের সবগুলো শিবিরকে এই উদ্যোগের আওতায় আনা হবে।
এ প্রসঙ্গে ডব্লিউএফপির কান্ট্রি ডিরেক্টর ডম স্কাল্পেলি বিজ্ঞপ্তিতে জানান, “গত বছরের জুনে পুষ্টির চাহিদা সম্পন্ন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ছিল ৭৯ শতাংশ, চলতি বছরের নভেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে ৯০ শতাংশ। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে পুষ্টির পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।”
“আমরা আমাদের সব দাতাদের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ এবং ২০২৪ সালে তারা আরও এগিয়ে আসবেন বলে আমাদের বিশ্বাস,” বলেন তিনি।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, চলতি বছর রোহিঙ্গাদের খাদ্য ব্যয় মেটাতে ১৮০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য এলে মাথাপিছু ১২ দশমিক ৫০ মার্কিন ডলার দেয়ার চেষ্টা করা হবে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের স্বাস্থ্য বিষয়ক সমন্বয়কারীর ডা. আবু তোহা এম আর ভুঁইয়া বেনারকে বলেন, ফর্টিফায়েড রাইস “সাধারণ চালের সঙ্গে কিছু পুষ্টিগুণ যুক্ত করা এক ধরনের চাল। পুষ্টিহীনতার কারণে ম্যারাসমাস, রাতকানাসহ বিভিন্ন রোগ হয়, এই চাল সেসব রোগ থেকে মুক্তি দেবে।”
রেশন কমার কারণে এতদিন রোহিঙ্গাদের খাবার সংকট ছিল। ফলে অনেকেই পুষ্টিহীনতায় ভুগছিলেন বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশের সব ধরনের খাদ্য সহায়তায় এখন ফর্টিফায়েড রাইস দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে বেনারকে জানান খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।
“প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ মূলত ভাতের ওপর নির্ভরশীল। তারা অন্য ভিটামিন সেভাবে পায় না। এই চালে ছয়টি ভিটামিনের ঘাটতি পূরণ হবে,” বলেন মন্ত্রী।