কক্সবাজারের উখিয়ার একটি শরণার্থী শিবিরে রোববার সন্ধ্যায় এক অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৬০০ ঘর পুড়ে যাওয়ায় তিন হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় হারিয়েছেন। এই দুর্ঘটনায় কেউ নিহত না হলেও অন্তত ১৪ জন আহত হয়েছেন।
উখিয়ার পালংখালীর এই ক্যাম্প-১৬তে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি পরিবারে প্রায় ২২ হাজার শরণার্থী বসবাস করেন জানিয়ে ওই শিবিরের ক্যাম্প-ইন-চার্জ (সিআইসি) শঙ্কর কুমার বিশ্বাস সোমবার সকালে বেনারকে বলেন, “এক রোহিঙ্গা নারী পিঠা তৈরি করার সময় গ্যাসের চুলা থেকে এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি।”
“তবুও ঘটনাটি আমরা খতিয়ে দেখছি,” দুপুরে বেনারকে বলেন অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা নয়ন।
পরে ঘটনাটি তদন্তে সামছু-দ্দৌজাকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করার বিষয়টি বেনারকে নিশ্চিত করেছেন আরআরআরসি শাহ মোহাম্মদ রেজওয়ান হায়াত।
কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, রোববারের আগুনে ১৬ নম্বর ক্যাম্পের বি ও সি ব্লকের ৪৮০টি ঘর এবং তৎসংলগ্ন স্থানীয় বাংলাদেশিদের ১০টি বাড়ি ছাড়াও পাঁচটি লার্নিং সেন্টার, তিনটি মসজিদ ও একটি মাদ্রাসা সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। এ ছাড়া কিছু ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ।
“ঘটনার পর আমরা দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয় দিয়ে খাবারসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করছি,” বলেন সিআইসি শঙ্কর। “তাঁরা যাতে দ্রুত নতুন ঘরে ঠাঁই পায়, সেই প্রচেষ্টাও চলছে,” যোগ করেন এই কর্মকর্তা।
“কয়েকজন নিখোঁজ ছিল। তাদের খুঁজে পাওয়া গেছে,” উল্লেখ করে অতিরিক্ত আরআরআরসি বেনারকে বলেন, “আমরা বাঁশ, ত্রিপলসহ সব উপকরণ দিচ্ছি। যাতে দ্রুতই নতুন ঘর হয় তাদের।”
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ন্যাশনাল কমিউনিকেশন অফিসার তারেক মাহমুদ বেনারকে বলেন, “আগুন লাগার পরপরই আমাদের চারটি দল মাঠে কাজ করে যাচ্ছে। আক্রান্তদের আশ্রয় দিতে ত্রিপল দিয়ে বেশ কিছু অস্থায়ী ছাউনি তৈরি করা হয়েছে।”
![কক্সবাজার উখিয়ার পালংখালীর ১৬ নম্বর শরণার্থী শিবিরে আগুনে পোড়া ভিটায় বসে আছে এক রোহিঙ্গা কিশোরী। ১০ জানুয়ারি ২০২২। [আবদুর রহমান/বেনারনিউজ]](/resizer/v2/TWKAV6GRMRREH52NAIF3J7MXWE.jpg?auth=c2d752cd62f1f5d8afd226f5f0a8047688bc7098094d34ca3c009feade14cd7c&width=800&height=515)
' সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে '
আগুনে সহায় সম্বল হারানো গুরা মিয়া (৬০) বেনারকে জানান, কয়েকদিন পরই তাঁর বড়ো মেয়ে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। মেয়ে জামাইকে দেওয়ার জন্য নিজের জমানো অর্থের সাথে স্বজনদের কাছ থেকে ধারে নেওয়া টাকায় বেশ কিছু আসবাব কিনেছিলেন তিনি।
“সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন জানি না মেয়েকে কীভাবে বিয়ে দেবো। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে হয়তো এ বিয়েই ভেঙে যাবে,” বলেন তিনি।
সরেজমিন দেখা যায়, সোমবার দুপুরেও পরিবারের ১৪ সদস্যকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে আছেন গুরা মিয়া। “সন্ধ্যার পর শীতের কারণে শিশুদের অনেক কষ্ট হয়,” উল্লেখ করেন তিনি।
তাঁর চাচাতো ভাই আবদুর শুক্কুর (৬৫) এবং আবদুর রহমানও (৬০) আগুনে সব হারিয়েছেন। বেনারকে তাঁরা জানান, দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কিছু বের করার সময় পাননি। আগুনে গতি দেখে শিশুসহ পরিবারের সদস্যদের জীবন বাঁচাতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন তাঁরা।
“এনজিওর (বেসরকারি সংস্থা) লোকজন এসে রান্না খাবার ও বিস্কুটের বক্সসহ পানি দিয়ে গেছে। সেগুলো খেয়ে দিন পার করছি,” বলেন শুক্কুর।
“কিন্তু ব্যবহারের পানি নেই। টয়লেটেরও ব্যবস্থা নেই,” যোগ করেন রহমান।
ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও কিছু পাওয়ার আশায় অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে অনেক রোহিঙ্গাকে।
আটটি ইউনিটের দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় রবিবারের আগুন নেভানো সম্ভব হয় জানিয়েছেন ৮-এপিবিএন (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) উপ-অধিনায়ক কামরান হোসেন।
তিনি বলেন, “মূলত রোহিঙ্গাদের অসাবধানতার কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তাদের অসতর্কতার কারণে আরো অগ্নিকাণ্ড ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।” একই ভাষ্য সিআইসি শঙ্করেরও।
উখিয়া ফায়ার সার্ভিসের ইনচার্জ এমদাদ হোসেন বেনারকে বলেন, “বারবার আমরা সবাইকে সর্তক থাকতে বলেছি।”
“গত বছরে উখিয়ার ক্যাম্পগুলো অর্ধশতাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। শীতের সময় এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে। ঘন ঘরবাড়ি হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং আমাদের নেভাতেও কষ্ট হয়,” যোগ করেন এই কর্মকর্তা।
ক্যাম্পটির রোহিঙ্গা নেতা ও ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) স্বেচ্ছাসেবক মো. মিয়া জানান, “বিকেলে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দ্রুত আগুন নেভানোর চেষ্টা করি। কিন্তু অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রগুলো অকেজো ছিল। তা ছাড়া এমন জায়গায় আগুন ধরছিল, যা খুবই ঘিঞ্জি। সেখানে পৌঁছানোটাও খুব মুশকিলের ছিল।”
“রোহিঙ্গাদের অনেকেই গ্যাসের চুলা ব্যবহার করতে জানে না। যারা জানে তারাও অসতর্কভাবে রান্না করে। আবার দেখা যায় অনেকে অভাবের কারণে গ্যাসের চুলা-সিলিন্ডার বিক্রি করে কাঠের চুলা ব্যবহার করছে। এসব কারণেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেশি ঘটছে,” বলেন তিনি।
তাঁর মতে, সরকারের উচিত আগুন প্রতিরোধে ক্যাম্পের ঘরগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা এবং ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যাতে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌছতে পারে সেই ব্যবস্থা করা।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা শিবিরে এটি চলতি বছরের দ্বিতীয় অগ্নিকাণ্ড। গত ২ জানুয়ারি বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে লাগা আগুনে উখিয়ার ২০ নম্বর বর্ধিত শিবিরের একটি করোনা হাসপাতালের ৭০টি শয্যা আগুনে পুড়ে যায়।
এর আগে গত বছরের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালীতে আগুনে পুড়ে ১৫ জন রোহিঙ্গা মারা যান।