বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তি: দুই বছরের মধ্যে ফিরে যাবে রোহিঙ্গারা

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.01.16
ঢাকা
কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে কয়েকজন রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে কয়েকজন রোহিঙ্গা। ১৬ জানুয়ারি ২০১৮।
AP

দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শেষ করার বিষয়ে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার।

মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) প্রথম বৈঠকে এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করা হয়।

সোমবার থেকে টানা ১৩ ঘণ্টার বৈঠকের পর মঙ্গলবার সকালে চুক্তিটি চূড়ান্ত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রসচিব এম শহীদুল হক এবং মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিব মিন্ট থো নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন।

‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ নামের এই চুক্তি অনুযায়ী, প্রথম দলটি পাঠানোর সময় থেকে সম্ভাব্য দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে বলে নেপিদো থেকে মঙ্গলবার প্রকাশিত বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

রোহিঙ্গাদের প্রতিটি পরিবারকে একক ইউনিট ধরে যাচাই ও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে জানিয়ে “বৈঠকে তথ্য যাচাইয়ের ফরমও চূড়ান্ত করা হয়েছে,” বলে এতে জানানো হয়।

এদিকে “জানুয়ারির শেষে কিংবা ফেব্রুয়ারির শুরুতেই প্রত্যাবাসন শুরু হবে,” বলে মঙ্গলবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তাঁর কার্যালয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের অবহিত করেন।

উল্লেখ্য, গত আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী বিরোধী অভিযানের নামে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও ধর্ষণসহ অমানবিক অত্যাচার শুরু হলে দেশটি থেকে সাড়ে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

পুরোনো রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ।

সেনাবাহিনীর ওই অভিযান এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে শরণার্থীদের ফেরত নিতে সম্মত হয় মিয়ানমার।

প্রত্যাবাসন পদ্ধতি

চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন করবে যেখান থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নেওয়া হবে। মিয়ানমার শুরুতে দুইটি রিসেপশন সেন্টারের মাধ্যমে প্রত্যাবাসনকারী রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করবে।

পরে সাময়িকভাবে তাদের থাকার ব্যবস্থা হবে অস্থায়ী ক্যাম্পে। পাশাপাশি ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ভিটেমাটিতে দ্রুততার সঙ্গে বাড়িঘর পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা নেবে মিয়ানমার।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, “প্রত্যাবাসনের পর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জীবন-জীবিকার বিষয় নিশ্চিত করার বিষয়টি চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত আছে। চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারেও বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সম্মত হয়েছে।”

তবে কোন পর্যায়ে ইউএনএইচসিআরকে যুক্ত করা হবে তা তিনি খোলাসা করে বলেননি।

“প্রত্যাবাসনের কাজটি হবে রোহিঙ্গাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে, মর্যাদার সঙ্গে এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তাসহ,” বলেন শাহরিয়ার আলম।

এ প্রসঙ্গে মিয়ানমারের শ্রম, অভিবাসন ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব মিন্ট কায়াঙ “শরণার্থীদের গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরুর জন্য” সরকার প্রস্তু রয়েছে বলে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে মঙ্গলবার জানান।

“ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রস্তুত,” বলেন তিনি।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য ১২৪ একর জায়গা জুড়ে ৬২৫টি আবাসন তৈরি করা হয়েছে বলে সোমবার এক প্রতিবেদনে জানায় মিয়ানমাররের জাতীয় গণমাধ্যম।

এতে ৩০ হাজার শরণার্থীর বসবাসের ব্যবস্থা রয়েছে এবং মাসের শেষের দিকে আরো ১০০টির বেশি আবাসন তৈরি সম্পন্ন হবে বলেও প্রতিবেদনটিতে জানানো হয়।

সময়ের মধ্যে প্রত্যাবর্তন নিয়ে সন্দেহ

কূটনীতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সময়সীমা বাড়াতে হতে পারে।

এই চুক্তি স্বাক্ষরকে “ইতিবাচক অগ্রগতি” হিসেবে বর্ণনা করে মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমা বেনারকে বলেন, ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট অনুযায়ী মিয়ানমার প্রতিদিন বড় জোর ৭০০ মানুষকে গ্রহণ করতে পারবে।

“এতে করে মাসে প্রায় ২০ হাজার মানুষ ফিরতে পারবে। তাই আমার মনে হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সময়সীমা বাড়বে,” বলেন অনুপ কুমার চাকমা।

তাঁর মতে, “ফেরত পাঠানোটা সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে তাদের রাষ্ট্রহীন অবস্থা।”

তিনি বলেন, “আমরা তাঁদের প্রত্যাবাসন করতে পারি, কিন্তু কতকাল তারা রাখাইনে বাস করতে পারবে যদি তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া না হয়? কারণ যদি তারা তাঁদের জন্য নির্ধারিত এলাকা থেকে বের হয় তাহলে তাঁদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের মুখে পড়তে হতে পারে।”

সম্মতিপত্র থেকে চুক্তি

রোহিঙ্গাদের ঘরে ফেরার পথ তৈরি করতে গত ২৩ নভেম্বর নেপিদোতে দুই দেশের মধ্যে একটি সম্মতিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। ওই সম্মতিপত্র স্বাক্ষরের তিন সপ্তাহের মধ্যে ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠন করে দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু এবং যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্দিষ্ট চুক্তিতে সই করা কথা ছিল।

তবে সেই “জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ” গঠন করা হয় তিন সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পর, গত বছর ১৯ ডিসেম্বর। ঢাকায় ওই বৈঠকেই যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের টার্মস অব রেফারেন্স ঠিক করা হয়।

সম্মতিপত্র স্বাক্ষরের ৫৪ দিনের মাথায় দুই পক্ষ মঙ্গলবার ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চূড়ান্ত করল। আর প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য সম্মতিপত্রে নির্ধারিত দুই মাস সময় শেষ হচ্ছে ২৩ জানুয়ারি।

ইউএনএইচসিআরের বিবৃতি

চুক্তি স্বাক্ষরের প্রতিক্রিয়ায় ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র অ্যান্ড্রেজ ম্যাসি মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে দুই দেশের মধ্যে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া এবং রোহিঙ্গাদের বল পূর্বক ফেরত পাঠানোর পরিবর্তে স্বতঃপ্রণোদিত প্রত্যাবাসনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

তিনি বলেছেন, “শরণার্থীদের কথা শুনতে হবে, বাংলাদেশে অবস্থানকালে এবং মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার পর তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। আমরা এসব বিষয় নিয়ে আলোচনায় অংশ নিতে চাই।”

“রোহিঙ্গারা আমাদের বলেছেন যে তারা ফেরত যাওয়ার আগে মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্ব বিষয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি দেখতে চান। রাখাইনে তাঁদের নিরাপত্তা এবং মৌলিক অধিকারগুলো ভোগ করতে চান।”

তাঁদের প্রাক্তন আবাসস্থলের বর্তমান পরিস্থিতি শরণার্থীদের জানাতে হবে। তাদের নিরাপত্তা উদ্বেগ নিরসন করতে হবে এবং তাদের ইচ্ছার কথা তাদের প্রকাশ করতে দিতে হবে। তাদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য আনান কমিশনের সুপারিশ সমূহের প্রত্যয়যোগ্য বাস্তবায়ন দরকার।

কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী রাখাইনে সাম্প্রদায়িক বিভাজন কমাতে হবে, মুসলিম সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান করতে হবে এবং সকল সম্প্রদায়ের মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা দেখতে চাই মিয়ানামার সরকার জরুরি ভিত্তিতে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করছে।

তথ্য সহায়তা: বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়া।