রাখাইনে কম ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামের রোহিঙ্গাদের দিয়ে শুরু হবে প্রত্যাবাসন

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.01.17
ঢাকা
টেকনাফের লেদা শরণার্থী শিবিরের সামনে কয়েকটি রোহিঙ্গা শিশু। টেকনাফের লেদা শরণার্থী শিবিরের সামনে কয়েকটি রোহিঙ্গা শিশু। ৭ জানুয়ারি ২০১৮।
আবদুর রহমান/বেনারনিউজ

‘স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদাপূর্ণ’ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে প্রথম দফায় রাখাইনের কম সহিংসতা ঘটা গ্রামগুলো থেকে আসা রোহিঙ্গাদের নামের তালিকা প্রস্তুতের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ। এ দফায় এক লাখ শরণার্থীর তালিকা করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

কম ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষেরা প্রথমে স্বেচ্ছায় রাখাইনে যেতে রাজি হবেন এবং তাঁরা ভালোভাবে প্রত্যাবসিত হলে অন্যান্য শরণার্থীরাও সেখানে ফিরে যেতে আগ্রহী হবেন—এমনটাই ভাবছেন তাঁরা।

মঙ্গলবার নেপিদোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তি অনুযায়ী, আগামী দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শেষ করার কথা। আর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই প্রথম ব্যাচের রোহিঙ্গারা রাখাইন ফিরবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

“আমরা প্রত্যেক প্রত্যাবাসীর মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেব। কাউকে জোর করে ফেরত পাঠানো হবে না। তবে দশ লাখের মধ্যে প্রথমে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে কম সহিংসতা ঘটা গ্রামের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করতে চাই,” বেনারকে বলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালক মনজুরুল করিম খান চৌধুরী।

তিনি বলেন, “কম সহিংসতা ঘটা গ্রামের মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক কম। তারা সহজে ফিরে যেতে চাইবে। আবার বেশি সহিংসতা ঘটা গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের মধ্যে শঙ্কা বেশি। প্রথমে তারা যেতে চাইবে না। তবে প্রথম দফায় ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গারা যদি ভালোভাবে থাকেন, তাহলে অন্যান্যরাও ফিরে যেতে রাজি হবেন।”

সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবতা বুঝে একসময় শরণার্থীরা নিজেদের দেশে ফিরে যেতে রাজি হবে বলে মনে করেন এই কূটনীতিক।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা যায়, রাখাইনের রোহিঙ্গা গ্রাম পার ওয়া চু হলো সবচে বেশি সহিংসতা উপদ্রুত এলাকার একটি। এ ছাড়া বুথিডং, মংডুর রোহিঙ্গা এলাকায় ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, রাখাইনে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ২’শ ১৪টি গ্রামের শতকরা ৯০ ভাগ অবকাঠামো পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ-মিয়ানমার জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম সভায় সিদ্ধান্ত হয়, যেসব শরণার্থী সীমান্তের জিরো-লাইনে অবস্থান করছেন তাদের প্রথমে ফেরত পাঠানো হবে।

গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী সংগঠন আরসার আক্রমণের পর লাখ লাখ মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তারা সীমান্ত এলাকায় জড়ো হয়। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র ও আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার মাধ্যমে তাদের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় দেওয়া হয়।

তবে ইউএনএইচসিআর’র তথ্যানুযায়ী, গত কয়েক সপ্তাহে রাখাইন থেকে আসা ৯,৪০০ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো লাইনে অবস্থান করছেন। গত রোববার তাদের বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে সরিয়ে নেয় ইউএনএইচসিআর।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশই গত ২৩ নভেম্বর সম্পাদিত প্রত্যাবাসন চুক্তিতে প্রথমবারের মতো বলেছে যে প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাপূর্ণ।”

“তাই আমরা কাউকে জোর করে ফেরত পাঠাব না। আমরা তাঁদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন,” বলেন আলম।

তিনি বলেন, “রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ হয়েছে। তবু এখন যারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন, অথবা জিরো-লাইনে অবস্থান করছেন তারা রাখাইনে খাদ্য-পানীয়সহ মৌলিক চাহিদার সমস্যার কারণে এখানে আসছেন। আবার অনেকে তাদের হারিয়ে যাওয়া আত্নীয়-স্বজনদের খুঁজতেও আসছেন।”

“তারা ফিরে যাবেন। রাখাইনে পরিস্থিতি আরও উন্নত হলে তারা ধীরে ধীরে সবাই ফিরে যাবে,” বলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আলম।

এদিকে রাখাইনের বুচিডং ও রাছিডং থানার বাসিন্দারা বেনারকে জানান, সেখানে রোহিঙ্গাদের হত্যা করা না হলেও নির্যাতন হয়েছে অন্য উপায়ে। শারীরিকভাবে নির্যাতন করা না হলেও তাদের খাদ্যসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে দেওয়া হয়নি। ঘরের মধ্যে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল।

মিয়ানমার রাছিডং থেকে পালিয়ে আসা ৫৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ আলী বেনারকে বলেন, “আমাদের গ্রামে সেনাবাহিনী জ্বালাও পোড়াও করেনি। তবে আমরা এক প্রকার অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলাম।”

তিনি বলেন, “ঘরের মধ্যে যে সব খাদ্যসামগ্রী রয়েছে তা ফুরিয়ে যাওয়ায় কাজের সন্ধানে অথবা খাদ্য সংগ্রহ করতে বাইরে গেলে নেমে আসে নির্যাতন। সবকিছু কেড়ে নেওয়ার পরও নির্যাতন বন্ধ হয় না। জাতিসংঘ অথবা অন্য কোনো বিদেশি সংস্থাকে ত্রাণ দিতে দিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার।”

“তাই তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে রাখাইনে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের উৎপাদিত ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার বাহিনী। খাদ্য সংকটের কারণে মূলত তাঁদের গ্রামের লোকজন দেশ ছেড়েছে,” বলেন মোহাম্মদ আলী।

“শরণার্থী জীবন সুখের নয়। তাই সময় অতিবাহিত হলে রোহিঙ্গারা ধীরে ধীরে রাখাইনে ফিরে যেতে রাজি হবে,” বেনারকে বলেন মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমা।

তিনি বলেন, “মূল বিষয় হলো রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতির ব্যবস্থা করতে হবে। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা গেলে তারা সবাই রাখাইনে ফিরে যেতে চাইবে।”

অনুপ চাকমা মনে করেন, “বাংলাদেশ মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত রাখতে পারলে দেশটি হয়তো কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে পারে। তবে রাখাইনের স্থানীয় রাজনীতিকেরা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের ঘোরতর বিরোধী।”

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাঁচ মিলিয়নের নতুন ফান্ড

রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পাঁচ মিলিয়ন ইউরো মূল্যের একটি নতুন ফান্ড ঘোষণা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই অর্থ রোহিঙ্গাদের চিহ্নিতকরণ ও নিবন্ধনের জন্য এবং তাঁদের নিরাপত্তার জন্য ব্যয় করা হবে বলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

এই অর্থ সাহায্য প্রদান রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিশ্রুতির বহিঃপ্রকাশ। একই সঙ্গে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ২৩ নভেম্বর স্বাক্ষরিত দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন চুক্তি বাস্তবায়নে সহায়তা করতে চায়।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে তুষার তুহিন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।