রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমারের সাথে বৈঠক, আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত নেই
2021.01.19
ঢাকা
কোনো নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ ছাড়াই শেষ হয়েছে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ মিয়ানমারের মধ্যকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক বহু প্রতীক্ষিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠক।
বাংলাদেশ বলেছে, গ্রাম বা অঞ্চলভিত্তিক প্রত্যাবাসনের কথা; অন্যদিকে মিয়ানমার চায় এখন পর্যন্ত দেশটি যতজনকে যাচাই-বাছাই করেছে তাঁদের দিয়েই প্রত্যাবাসন শুরু করতে।
মঙ্গলবার প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী ভার্চুয়াল বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুও জাওহুই এবং মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা উপমন্ত্রী হাউ দো সুয়ান নিজ নিজ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।
বৈঠকের পরে মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা গ্রামভিত্তিক প্রত্যাবাসনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তবে মিয়ানমার বলেছে, যে ৪২ হাজার রোহিঙ্গা যাচাই বাছাই করেছে, তাদের দিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু করার কথা।”
বাংলাদেশ এ পর্যন্ত যাচাই বাছাইর জন্য মিয়ানমারকে আট লাখ চল্লিশ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার তথ্য সরবরাহ করেছে বলেও জানান তিনি, যার মধ্যে মিয়ানমার যাচাই সম্পন্ন করেছে মাত্র ৪২ হাজার।
“গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পরস্পর পরস্পরকে চেনে বা একই গ্রাম বা একই এলাকা থেকে এসেছে এমন লোকদের একসঙ্গে পাঠানো, যাতে করে তারা যেতে উৎসাহ বোধ করে। এটা আরও বেশি বাস্তবসম্মত হবে,” বলেন তিনি।
গত তিন বছরে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে ৯০ হাজার নতুন শিশুও জন্মগ্রহণ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরুর বিকল্প নেই।”
প্রত্যাবাসন কবে নাগাদ শুরু হতে পারে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “আমরা মার্চের মধ্যে শুরুর কথা বললে মিয়ানমার লজিস্টিক কিছু সমস্যা আছে বলে জানায়। হয়তো আরও কিছু সময় লাগবে।”
“জুনের মধ্যে আমরা আশা করতে পারি,” জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি সাবধানতার সঙ্গে আশাবাদী।”
আগামী ফেব্রুয়ারিতে ওয়ার্কিং গ্রুপের পরবর্তী বৈঠকে এ বিষয়ে একটা সমাধান হবে বলেও আশা করেন সচিব।
প্রথমে করোনাভাইরাস মহামারি ও পরে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনের কারণে গত বছর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সাথে আলোচনা প্রায় বন্ধই ছিল।
এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে আলোচনা আবার শুরু হওয়া একটি ‘ভালো দিক’ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন।
তাঁর মতে, “চীনের মতো রাষ্ট্র রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে অন্ধভাবে সমর্থন করে কিছুটা ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে, তাদের কিছুটা উপলব্ধিও হয়েছে। তারপরেও দেখার বিষয় চীন কতটা সাহস দেখাতে পারে।”
এর আগে ২০১৮ সালের নভেম্বর ও ২০১৯ সালের আগস্টে দুই দফা প্রত্যাবাসনের দিন ঠিক হলেও রাখাইনে অনুকূল পরিবেশ না থাকায় কোনো রোহিঙ্গা ফিরতে রাজি হননি।
চীনের ভূমিকা
এক প্রশ্নের জবাবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের ওপর বাংলাদেশের আস্থা রাখা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “চীনের আগ্রহ ছিল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাধ্যমে প্রত্যাবাসন যেন এগিয়ে যায় এবং আমরা সরল বিশ্বাসে তাদের সঙ্গে গিয়েছি।”
তিনি বলেন, “আমার তো মনে হয় তাদের (চীনের) যথেষ্ট উদ্যোগ আছে।”
“চীনের পাশাপাশি জাপান, ভারত, আসিয়ান, জাতিসংঘ যদি এই প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত হয় তাহলে তারাও সহযোগিতা করতে পারে,” বলেন পররাষ্ট্র সচিব।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের উপর বাংলাদেশকে নির্ভর করতে হবে উল্লেখ করে ড. দেলোয়ার বলেন, “চীনের উপর মিয়ানমার নির্ভরশীল। স্থায়ী সদস্য চীনের কারণে নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব পাস করানো যায়নি। চীন আন্তরিকভাবে দেখলে এ সমস্যা সমাধান হতে পারে।”
চীনকে বিশ্বাস করার পাশাপাশি বাংলাদেশকে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দেন তিনি।
“এখানে চীনের রাজনীতি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দেশগুলো যাতে সুযোগ নিতে না পারে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বাস্তবে এটা (রোহিঙ্গা) আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সমস্যা। এর সমাধান দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিকভাবে হতে হবে।”
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ২০১৭ সাল থেকেই চীন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। চীনের উদ্যোগে মিয়ানমারের সাথে সর্বশেষ ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত বছরের ২০ জানুয়ারি।
আরসা নিয়ে উদ্বেগ
মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, উপমন্ত্রী হাউ দো দ্বিপক্ষীয় চুক্তি কঠোরভাবে মেনে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার উপর জোর দেন।
এতে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ বিষয়ক পাইলট প্রকল্পের আওতায় যাচাই করা ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রক্রিয়া শুরু করতে ইচ্ছুক। মিয়ানমারে ফিরতে ইচ্ছুক হিন্দু রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে জানানো হয়, বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী প্রত্যাবাসিত না হতে বাস্তুচ্যুতদের (রোহিঙ্গাদের) ভয় ও হুমকি দিচ্ছে বলেও বাংলাদেশ অবহিত করেন মিয়ানমারে উপমন্ত্রী।
“আমরা বলেছি, আমাদের দেশে কোনো সন্ত্রাসীর আশ্রয় নেই। কিছু অপরাধী থাকলেও, তাদের কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক পরিচয় নেই,” এ প্রসঙ্গে বলেন মাসুদ বিন মোমেন।
এছাড়া বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির ওপর বাংলাদেশ জোর দিয়ে মিয়ানমারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বলেও জানান সচিব।
ভাসানচরে নতুন থানা
মঙ্গলবার নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার ভাসানচরে নতুন থানা উদ্বোধন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ভাসানচর ও এর আশেপাশের এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য নোয়াখালী জেলার দশম এই থানা গঠিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এর দায়িত্বে থাকবেন একজন পুলিশ পরিদর্শক।
তিনি বলেন, “ভাসানচরের সুযোগ সুবিধা ও নিরাপত্তা দেখে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গারা দলে দলে এখানে আসবে।”
ভাসানচরে বর্তমানে সাড়ে তিন হাজারের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছেন।
ভাসানচর থেকে হেলিকপ্টারযোগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কক্সবাজারে উখিয়ার কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা শিবিরে যান। সেখানে ৩৬টি শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
“এ সময় মন্ত্রী মহোদয় আমাদের ক্যাম্পে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রেখে বসবাসের আহবান জানান,” বেনারকে জানান বৈঠকে অংশগ্রহণকারী কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান মো. রফিক।
“প্রধানমন্ত্রী কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভাসানচরে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করেছেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গারা চাইলেই ভাসানচরে যেতে পারেন,” বলেন রফিক।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে সুনীল বড়ুয়া।