আন্তর্জাতিক আদালতের অন্তবর্তী আদেশে নিরাপদে ফেরার স্বপ্ন দেখছেন রোহিঙ্গারা
2020.01.23
ঢাকা ও কক্সবাজার
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযানের সময় রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে—এমন অভিযোগে গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন যেসব আদেশ দিয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট রোহিঙ্গারা।
এই আদেশকে নিজেদের অধিকারের স্বীকৃতি হিসাবে গণ্য করে তাঁরা নিরাপদে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন এক ভিডিও বার্তায় আইসিজে’র নির্দেশনাকে রোহিঙ্গা ও মানবতার জয় হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এর ফলে রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ হবে। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যাবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস এর সহসভাপতি মাস্টার আব্দুর রহিম বেনারকে বলেন, “আমরা যে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন আশা করছি, এই রায়ের মাধ্যমে তা সম্ভব হবে বলে মনে করছি। আজকের রায়ের কারণে সকল রোহিঙ্গা খুশি।”
তিনি বলেন, “মিডিয়া থেকে শুরু করে যারা আমাদের জন্য কাজ করেছে সবার জন্য আমরা শুকরিয়া আদায় করছি। আমরা যে আশা করেছিলাম, সেই আশা আল্লাহ পূরণ করবে বলে মনে করছি।”
আব্দুর রহিম বলেন, “এ রায়ের মাধ্যমে আরাকানে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে সেখানে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আমরা সেখানে ফিরে যেতে পারব।”
উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া শরণার্থী শিবিরের শাহানা আক্তার বেনারকে বলেন, “গাম্বিয়া যে মামলাটি করেছে, সেখানে আমাদের সুখ-দুঃখের কথা হয়েছে। সে জন্য আমরা খুব খুশি হয়েছি। শুকরিয়া জানাচ্ছি।”
তিনি বলেন, “আজকের এ রায়ের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা জাতি হিসাবে মিয়ানমারে স্বীকৃতি পাবে বলে মনে হচ্ছে।”
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালানোর অভিযোগ রয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে এ সময় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন।
নতুন পুরোনো মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। তাঁরা মূলত কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
তাঁদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশের সাথে প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর করে মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সকল প্রকার আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও সে দেশে ফিরে যাননি।
শরণার্থীরা বলছেন, রোহিঙ্গারা জাতিসত্তা হিসাবে স্বীকৃতি না পেলে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের বিচার না হলে তাঁরা মিয়ানমার ফিরে যাবেন না।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের নৃশংসতাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর আইসিজেতে মামলা করে গাম্বিয়া।
মামলায় প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও সংঘাত যাতে আরও তীব্রতর না হয় এ জন্য বৃহস্পতিবার জরুরি কিছু বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত।
আদালতের চারটি আদেশের মধ্যে রয়েছে; জাতিসংঘ কনভেনশন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে হবে, গণহত্যার প্রমাণ ধ্বংস করা যাবে না, সশস্ত্র বাহিনী ফের কোনো গণহত্যা ঘটাতে পারবে না এবং রায়ের তারিখের চার মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে মিয়ানমারকে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হবে। পরবর্তীতে বিচারের চূড়ান্ত রায় প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ছয় মাসে একটি করে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
আদালতের রায় টেলিভিশন ও ওয়েবসাইটে সরাসরি দেখতে শরণার্থীশিবিরের বিভিন্ন দোকানপাট ও অন্যান্য স্থানে একত্রিত হন রোহিঙ্গারা।
বিকেল চারটার পরে রায় ঘোষণা শেষ হলে রোহিঙ্গারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে চিৎকার করতে থাকেন। কেউ কেউ কেঁদে ফেলেন। আবার কেউ আল্লাহর কাছে দুহাত তুলে মোনাজাত করেন।
রোহিঙ্গাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অন্তর্বর্তী নির্দেশনা দেখার সুযোগ দিতে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা বা থ্রি-জি ও ফোর-জি চালু করতে মোবাইল কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন।
ফলে রোহিঙ্গারা মামলার রায় দেখতে পান।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন—বিটিআরসির জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন খান সাংবাদিকদের বলেন, বৃহস্পতিবার চালু হয়ে শরণার্থী শিবিরে শুক্রবার রাত ১২টা পর্যন্ত থ্রি-জি ও ফোর-জি চালু থাকবে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নির্দেশনা দেখার সুযোগ দিতে এ সেবা সাময়িক চালু করা হয়েছে।
নিরাপত্তার স্বার্থে গত সেপ্টেম্বর মাসে বিটিআরসির নির্দেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় থ্রি-জি ও ফোর-জি সেবা বন্ধ করে দেয় অপারেটরগুলো।
‘রোহিঙ্গাদের জয়, মানবতার জয়’
বিদেশ সফররত পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন হোয়াটসঅ্যাপে সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো এক ভিডিও প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আজকে বিশ্ব আদালত রোহিঙ্গাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। এতে মানবতার জয়গান হয়েছে। এই রায়ের জন্য আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাই।”
তিনি বলেন, “এটি মানবতার জয়। মানবাধিকার রক্ষায় এই রায় সারা বিশ্বে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।”
এই রায়ের ফলে ভবিষ্যতে নির্যাতন, জেনোসাইড, এথনিক ক্লিনজিং বন্ধ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রী।
মোমেন বলেন, “এর ফলে মিয়ানমার যা আমাদের কাছে অঙ্গীকার করেছে যে তারা তাদের লোকদের নিয়ে যাবে। এখন তারা তাদের লোকদের নিয়ে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।”
তিনি বলেন, “সেই সাথে তারা আমাদের কাছে অঙ্গীকার করেছে যে, তারা তাদের সেফটি ও সিকিউরিটি দেবে। আদালতের রায়ে তাদের সেফটি ও সিকিউরিটি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এই রায়ে রোহিঙ্গাদের জয় হয়েছে। তারা এখন নিরাপদ অবস্থায় তাদের দেশে ফিরতে পারবে। এ রায় হচ্ছে ওআইসির জয়, গাম্বিয়ার জয় এবং বাংলাদেশের জয়।”
নিরাপত্তা পরিষদের সমালোচনায় জাতিসংঘের দূত
বৃহস্পতিবার দুপুরে বাংলাদেশ সফররত মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি অধ্যাপক ইয়াংহি লি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ বিভিন্ন মানবতা বিরোধী অপরাধের যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ।
তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া ও চীন মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে। মিয়ানমারকে সমর্থন দেয়া এই দুটি দেশের জন্য ‘লজ্জাজনক’ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অধ্যাপক ইযাংহি লি বলেন, মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া অপরাধের জন্য দায়ীদের বিচার করতে তিনি আন্তর্জাতিক অন্তর্বর্তী ট্রাইব্যুনাল গঠনের পক্ষে জোর দিচ্ছেন। তিনি বলেন, সিয়েরা লিওন, রুয়ান্ডা ও বসনিয়া হার্জেগোভিনার মতো ওই অন্তর্বর্তী ট্রাইব্যুনাল গঠন হতে পারে।
তবে তিনি ট্রাইব্যুনালের কাজের পরিধি সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
অধ্যাপক লি বলেন, চীন বিশ্বের অন্যতম শক্তি হতে যাচ্ছে। চীনের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, মানবাধিকারকে সম্মান না করে বিশ্ব নেতা হওয়া যায় না।