মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশ

বিশেষ প্রতিবেদন
2020.01.23
ওয়াশিংটন ডিসি
200123_ICJ_Rohingya_622.jpg নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) রায়ের অপেক্ষায় গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবরক মেরি তাম্বাদাউ (সামনে ডানে) ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা (পেছনে)। ২৩ জানুয়ারি ২০২০।
[এএফপি]

মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাদের গণহত্যা থেকে সুরক্ষার জন্য বৃহস্পতিবার দেশটির প্রতি আদেশ জারি করেছে জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) এর ১৭ জন বিচারক সর্বসম্মতভাবে রোহিঙ্গা নির্যাতন সংক্রান্ত যে সব আলামত ভবিষ্যতে আদালতের শুনানিতে ব্যবহার হতে পারে, সেগুলো নষ্ট না করার জন্যও নির্দেশনা দিয়েছেন দেশটির প্রতি।

পশ্চিম আফ্রিকার মুসলমি সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র দেশ গাম্বিয়া ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার পক্ষে গত নভেম্বরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলাটি দায়ের করে।

এতে অভিযোগ করা হয়, ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের দমনমূলক অভিযানের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিতাড়নের সময় ১৯৪৮ সালের গণ্যহত্যা বিষয়ক কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে।

মিয়ানমারকে নতুন করে রোহিঙ্গাদের অধিকার লঙ্ঘন থেকে বিরত থাকতে গত ডিসেম্বরে এক শুনানিতে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারির অনুরোধ জানায় গাম্বিয়া। যার ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার এই আদেশ জারি করে আইসিজে।

বৃহস্পতিবার আইসিজে মিয়ানমারের প্রতি চারটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারি করে।

আদেশগুলো হলো: জাতিসংঘ কনভেনশন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে হবে, গণহত্যার প্রমাণ ধ্বংস করা যাবে না, সশস্ত্র বাহিনী ফের কোনো গণহত্যা ঘটাতে পারবে না এবং রায়ের তারিখের চার মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে মিয়ানমারকে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হবে।

এছাড়া পরবর্তীতে বিচারের চূড়ান্ত রায় প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ছয় মাসে একটি করে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।

আইসিজে পরবর্তীতে আদেশটি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে পাঠাবে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালানোর অভিযোগ রয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। এ সময় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মৃত্যুবরণ করেন। এছাড়াও রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ ও রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ রয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।

সেনাবাহিনীর ওই নির্যাতন থেকে প্রাণে বাঁচতে ওই সময় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। নতুন পুরোনো মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।

জাতিসংঘ সমর্থিত নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের (এফএফএম) ২০১৮ সালের এক তদন্তে দেখা গেছে যে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার অভিপ্রায়’ ছিল।

তবে মিয়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনী উভয়ই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

মিয়ানমারে বর্তমানে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন, যাদের প্রায় এক লাখ রয়েছেন অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যূত শিবিরে।

মিয়ানমারে এখনো থেকে যাওয়া রোহিঙ্গারা “পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়েও বড় ধরনের গণহত্যার মুখোমুখি হতে পারেন,” বলে ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করে এফএফএম।

তবে গত ডিসেম্বরে আইসিজের শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষে নেতৃত্বদানকারী দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচি রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগ ‘একটি অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাতের ফল’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর মতে, যা শুরু হয়েছিল মুসলিমদের (রোহিঙ্গা) জঙ্গি গোষ্ঠী কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার প্রেক্ষিতে দেশটির সরকারি বাহিনী আক্রমণকারীদের ‘বিতাড়নের’ অভিযান পরিচালনার সময়।

তিনি মামলাটি খারিজ করে দেবার জন্যও আন্তর্জাতিক আদালতে আবেদন জানিয়েছিলেন।

এদিকে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনসহ অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ হাজির করা সত্ত্বেও, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ তদন্তের জন্য ২০১৮ সালে মিয়ানমারের গঠিত ইনডিপেন্ডেন্ট কমিশন অফ ইনকোয়ারি (আইসিওই) গত সোমবার তাদের প্রতিবেদনে জানায় যে, দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী যুদ্ধাপরাধ এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও ‘গণহত্যার উদ্দেশ্য’ নিয়ে কাজ করেনি।

একটি ‘বড় বিজয়’

বর্তমানে মিয়ানমারে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের প্রমাণ সংরক্ষণের জন্য আদালতের আদেশকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

“আইসিজে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা রোধে মিয়ানমারের প্রতি যে আদেশ দিয়েছে, তা বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত এই জনগোষ্ঠীর ওপর অধিকতর অত্যাচার বন্ধে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ,” বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এর সহযোগী পরিচালক পরম-প্রীত সিং।

তিনি বলেন, “গণহত্যার মামলা চলার পাশাপাশি এখন আদেশটি কার্যকর করা হচ্ছে কি না তা সংশ্লিষ্ট সরকার এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর নিশ্চিত করা প্রয়োজন।”

এদিকে আদালতের আদেশটিকে “মিয়ানমারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রতি একটি বার্তা: বিশ্ববাসী তাঁদের নৃশংসতা সহ্য করবে না, এবং রাখাইন রাজ্যের বর্তমান বাস্তবতা বিষয়ে তাঁদের ফাঁপা বক্তব্য গ্রহণ করবে না,” বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাজ্য ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আঞ্চলিক পরিচালক নিকোলাস বেকুয়েলিন।

বিবৃতিতে তিনি বর্তমানে মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশ মেনে চলার জন্য দেশটির প্রতি আহ্বান জানান।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভিত্তিক ফরটিফাই রাইটসের প্রধান নির্বাহী ম্যাথু স্মিথ আইসিজের আদেশকে “রোহিঙ্গাদের জন্য একটি বড় বিজয়,” হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

মালয়েশিয়ার আইনজীবি ও মানবাধিকার বিষয়ক আসিয়ান সংসদ (এপিএইচআর) এর চেয়ারম্যান চার্লস সান্টিয়াগো এক বিবৃতিতে বলেছেন, এই রায় ইঙ্গিত দেয় যে মিয়ানমার রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে আর দায়মুক্তির সুযোগ নিতে পারবে না।
“আইসিজের সিদ্ধান্ত মিয়ানমারকে একটি স্পষ্ট বার্তা দেয় যে, বিশ্ব দেখছে, এবং দায়মুক্তির সুযোগ নিয়ে তারা আর রোহিঙ্গাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না।”

প্রসঙ্গত, কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করলেও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে না, বরং তাদেরকে বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে গণ্য করে থাকে।

প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়ার রোজান গেরিন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।