ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর পরিকল্পনা বিলম্বিত করার আহ্বান জাতিসংঘের

কামরান রেজা চৌধুরী ও মেঘ মনির
2019.01.25
ঢাকা
190125_rohingya_UN-Press_1000.jpg ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি। ২৫ জানুয়ারি ২০১৯।
[মেঘ মনির/বেনারনিউজ]

কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নোয়াখালীর ভাসানচর দ্বীপে স্থানান্তরের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের ‘সতর্কতা’ ও ‘ধৈর্য’ প্রত্যাশা করছেন মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি।

তাঁর মতে, তাড়াহুড়ো করে তাঁদের স্থানান্তর করা উচিত হবে না। বাংলাদেশে ছয় দিনের সফর শেষে শুক্রবার বিকেলে ঢাকার লা মেরিডিয়ান হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

“দ্বীপটির সুরক্ষা কাঠামো নিয়ে সরকার মানবিক সম্প্রদায়ের সাথে আজ পর্যন্ত কোনো আলোচনা করেনি,” উল্লেখ করেন ইয়াংহি।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, “ওই দ্বীপে আবাসনের আরও পরিকল্পনা গ্রহণের আগে আমি সরকারের তৈরি সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময়ের পাশাপাশি জাতিসংঘকে সেখানে পূর্ণাঙ্গ কারিগরি, মানবিক ও নিরাপত্তা সমীক্ষা চালাতে অনুমতি দেওয়ার আহবান জানাচ্ছি।”

বাংলাদেশ সরকারের এই শরণার্থী স্থানান্তরের উদ্যোগকে জাতিসংঘ সহায়তা করবে কিনা, বেনার প্রতিনিধির এমন প্রশ্নের জবাবে লি বলেন, “তবে আমি কারিগরি বা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ নই। বিষয়টিকে সম্পূর্ণ মানবাধিকার এবং মানবিক প্রেক্ষাপট থেকেই বিবেচনা করছি।”

“নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য পূরণ না হওয়া অবধি শরণার্থী স্থানান্তরে এই আকাঙ্ক্ষার গতি কিছুটা শ্লথ রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি। আগে সেখানকার মানবিক, মানবাধিকার ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির মূল্যায়ন করা উচিত।”

“আমার মনে হয় সরকার ফের সেখানে বাসযোগ্যতার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সমীক্ষা চালাবে এবং তার ফলাফল জাতিসংঘ এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের দেবে। তখন বোঝা যাবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর আদৌ কতটা সম্ভব,” যোগ করেন তিনি।

এদিকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে জাতিসংঘের সাথে আলোচনা হচ্ছে, এবং তাদেরকে ওই চরের পরিস্থিতির ওপর একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রোহিঙ্গা সেলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, “আমরা আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করেই রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করতে চাই। আমরা আশা করি জাতিসংঘের সংস্থাগুলো আমাদের স্থানান্তর পরিকল্পনার বিরোধিতা করবে না।”

গত শনিবার বাংলাদেশে আসার পর টানা তিনদিন কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে বৃহষ্পতিবার ইয়াংহি লি ভাসানচর পরিদর্শন করেন। এর আগে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনসহ সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সাথেও মতবিনিময় করেন।

ভাসানচরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও আশপাশের এলাকা পরিদর্শনের কথা উল্লেখ করে লি বলেন, “এটা আমার কাছে স্পষ্ট যে সরকার সেখানে বাঁধ ও ভবন নির্মাণের জন্য প্রচুর প্রচেষ্টা ও সম্পদ বিনিয়োগ করেছে।”

সরকার জাতিসংঘের এই দূতকে জানিয়েছে, ভাসানচরে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের শরণার্থীদের মতোই মৌলিক সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার পাবে। সেখানে তাদের প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, মাছ শিকার ও খামারের মতো জীবিকার সুবিধা দেওয়া হবে।

রোহিঙ্গারা চরের মধ্যে অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা পাবে। তাদের কক্সবাজারে অবস্থানকারী পরিবারের সদস্য বা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা করার সুযোগও দেওয়া হবে। তবে তারা বাংলাদেশের অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ পাবে না।

সংবাদ সম্মেলনে ভাসানচর দ্বীপের ‘বিচ্ছিন্নতা’ এবং ‘দুর্যোগ প্রবণতা’ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন ইয়াংহি। তিনি মনে করেন, রোহিঙ্গাদের সেখানে স্থানান্তরের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা থাকতে হবে এবং শরণার্থীদের সেই রূপরেখায় সম্মতি থাকতে হবে।

“রোহিঙ্গাদের পূর্ণসমর্থন ছাড়া এই পরিকল্পনা আগানো উচিত না,” বলেন তিনি।

গত বছর ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান শুরু হলে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় পালিয়ে আসে।

সেখানে আগে থেকে অবস্থান করা আরও প্রায় তিন লাখসহ কমপক্ষে এগারো লাখ বাড়তি মানুষ এখন উপজেলা দুটির শরণার্থী শিবিরে অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছে।

কক্সবাজারের ওপর চাপ কমাতে এক লাখের মতো রোহিঙ্গা স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ভাসানচরে ৪৫০ একর জমির ওপর আশ্রয় শিবির নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।

প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীকে। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ২,৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।

তবে ইয়াংহির পরামর্শ, প্রয়োজনে শরণার্থী প্রতিনিধিদের ভাসানচর পরিদর্শন করাতে হবে। যাতে তারা নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারে, তারা সেখানে যাবে কিনা।

মিয়ানমার সেনাপ্রধানের বিচার দাবি

সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরের পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ ব্যক্ত করেন জাতিসংঘ প্রতিনিধি। তিনি বলেন, “বিশেষ করে মাঝারি এবং দীর্ঘ মেয়াদে রোহিঙ্গাদের প্রয়োজন ও অধিকারগুলো পূরণ করার জন্য চলমান ব্যবস্থা যথেষ্ট কিনা তা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।”

মিয়ানমার সরকারের সমালোচনার কারণে দেশটিতে প্রবেশের অধিকার হারানো এই দূতের দাবি, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার মতো কোনো পরিবেশ তৈরি করেনি মিয়ানমার। এমনকি নিকট ভবিষ্যতেও সেখানে তাদের ফেরার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তিনি।

মিয়ানমার সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাংয়ের বিচার দাবি করে ইয়াংহি বলেন, “যে কোনও প্রত্যর্পণ শুরু হওয়ার আগে রাখাইন ও মিয়ানমারের অন্য অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে মিন অং হ্লাংয়ের বিচার হওয়া উচিত।”

ভারত ও সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী পাঠানোর ঘটনায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করে সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, “এই আঞ্চলিক সমস্যাটি এখন দ্রুতই একটি বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে উঠছে।”

এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করছেন ইয়াংহি।

এদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো পদক্ষেপ ছাড়া রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিশ্বপরিমণ্ডলে আজ যে ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছে, তাতে এটি আর কোনো দেশের আভ্যন্তরীণ বা দুই দেশের দ্বি-পাক্ষিক বিষয় নেই। আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরে নিতে চাইবে না।”

“মিয়ানমার সময় ক্ষেপণের কারণে সমস্যাটি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে বলেই দ্বি-পাক্ষিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এখন এটি সমাধানে বিশ্বসম্প্রদায়কেই এগিয়ে আসতে হবে,” বেনারের কাছে মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান।

বান্দরবানে বিজিপি আটক

সীমান্তবর্তী পার্বত্য জেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে বৃহস্পতিবার রাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এক সদস্যকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। আটক সেনা সদস্যের নাম অংবোথিন। আটকের সময় তাঁর পরনে সে দেশের সেনাবাহিনীর পোশাক ছিল।

বিজিবির কক্সবাজার সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল বায়েজিদ খান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে সাংবাদিকদের জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি নিজেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এলআইবি-২৮৭ ব্যাটালিয়নের সদস্য বলে দাবি করেছেন। তিনি বর্তমানে মিয়ানমারের বান্ডুলা ৫০ ক্যাম্পে দায়িত্বরত রয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে শরীফ খিয়াম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।