মিয়ানমারের আগ্রহ হিন্দু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে, বাংলাদেশ পাঠাতে চায় সবাইকে
2021.01.25
ঢাকা ও কক্সবাজার
শরণার্থী প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে মিয়ানমার চায় প্রথম ধাপেই যেন বাংলাদেশে থাকা পাঁচশো’র মতো হিন্দু রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়। অন্য দিকে বাংলাদেশের লক্ষ্য ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার সেলের মহাপরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেন সোমবার বেনারকে বলেন, “হিন্দু রোহিঙ্গাদের সংখ্যা পাঁচশোর কম। তাঁদের পাঠানোর বিষয়টি আমাদের অগ্রাধিকার না।”
“এ দেশে আশ্রয় নেওয়া মুসলিম রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এক মিলিয়ন। মুসলিম রোহিঙ্গারা ফেরত গেলে তারাও ফেরত যাবে।”
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ দেরি করছে বলে মিয়ানমারের অভিযোগ সত্য নয় মন্তব্য করে দেলোয়ার হোসেন বলেন, “রোহিঙ্গারা বোঝা হয়ে আছে; তাহলে বাংলাদেশ কেন দেরি করবে?”
গত ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যকার ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে হিন্দু রোহিঙ্গাসহ যাচাইকৃত রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের কাছে উত্থাপন করা হয় বলে সেদিনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় মিয়ানমারের পররাষ্ট্রদপ্তর।
মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অং কো বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপ কমে এলে প্রত্যাবাসনের প্রথম ধাপে চারশো’র বেশি হিন্দুসহ যাচাইকৃত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চান তাঁরা।
তবে প্রত্যাবাসন শুরুর দিনক্ষণ জানায়নি মিয়ানমার। এমনকি এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতেও তারা আরো সময় চেয়েছে বলে জানায় ঢাকা।
এটা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করতে মিয়ানমারের নতুন কৌশল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এহসানুল হক বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার প্রথম থেকেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে অনীহা প্রকাশ ও প্রত্যাবাসনকে প্রলম্বিত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। হিন্দু রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চাওয়াটাও এরই অংশ।”
“এর মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে তারা (মিয়ানমার) আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখাতে চায় যে, অন্তত কিছু রোহিঙ্গাকে তারা নিয়ে যেতে চাইছে।”
“মিয়ানমার এক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ, রাখাইনের উগ্রবাদী বৌদ্ধদের মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আপত্তি আছে। হিন্দুরা প্রত্যাবাসিত হলে তারা আপত্তি করবে না।”
‘নিরাপদ রাখাইনে’ ফিরতে চায় হিন্দুরা
কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালংয়ে হিন্দু শরণার্থী শিবিরের অবস্থান করছেন এই রোহিঙ্গারা। ২০১৯ সালে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ৪৪৪ জন হিন্দু রোহিঙ্গা কক্সবাজারের শিবিরে ছিল।
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, মিয়ানমারের দেওয়া তালিকার সাথে হিন্দুদের প্রকৃত সংখ্যা মেলে না।
বেনারের পক্ষ থেকে সরেজমিনে রোববার উখিয়ার কুতুপালংয়ে হিন্দু শরণার্থী শিবিরে দেখা যায়, সেখানে ১১৫ পরিবারে ৫৫০ জন সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে শিশু ২৫০, নারী ১২০ জন, বাকিরা পুরুষ। তাঁদের অন্তত ১৪ জনের সঙ্গে কথা হয় বেনার প্রতিবেদকের।
হিন্দু শরণার্থী শিবিরের মাঝি মিন্টু রুদ্র জানান, “এই শিবিরে গত সাড়ে তিন বছরে নতুন ৫০ শিশু জন্ম নিয়েছে। মোট সাড়ে পাঁচশ মানুষের বসবাস এখানে।”
২০১৭ সালে ২৫ আগস্টের পর সহিংসতা থেকে বাঁচতে মিয়ানমারের রাখাইনের বলিবাজার এলাকা থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালংয়ে অবস্থান নিয়েছেন শিশু শীল (৩২)।
হিন্দু এই শরণার্থী নেতা বেনারকে বলেন, “এই ক্যাম্পে বেশির ভাগ মানুষ রাখাইনের চিকনছড়ি এলাকার। প্রায় সাড়ে তিন বছর হয়ে যাচ্ছে এখানে আছি আমরা।”
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে শুরুতে ৬ মাস মুরগির খামারে ছিলেন উল্লেখ করে শিশু শীল বলেন, “এখন মোটামুটি ভালো আছি। এখানে নিরাপত্তাসহ সব ধরনের দেখভাল করছে সরকার। তবে আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই।”
“রাখাইনের পরিবেশ নিরাপদ হলে দুদেশের আলোচনার মাধ্যমে কোনো শর্ত ছাড়াই নিজ দেশে ফিরতে চাই,” বলেন তিনি।
হরিলতা শর্মা নামে এক হিন্দু শরণার্থী বলেন, “মিয়ানমারে আমাদের ফেরত যাবার কথা বারবার বলা হলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি। এখানকার সরকার যেভাবে নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছে, সেভাবে মিয়ানমারে বসবাসের নিশ্চয়তা পেলে এই মুহূর্তেই চলে যাব।”
বেনার প্রতিনিধি এর আগে ২০১৮ সালে হিন্দু শরণার্থী শিবিরে যে ঘিঞ্জি পরিবেশ দেখেছিলেন, এবার তার বিপরীত চিত্র দেখতে পেয়েছেন। সেখানে বসবাসের পরিবেশ ভালো।
মিয়ানমারের চিকনছড়ি গ্রাম থেকে সাড়ে তিন বছর আগে স্ত্রীকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা পরিন্দ্র শীল (৬০) জানান, “এখানে ভালো আছি। তবু খুব দ্রুত মিয়ানমারে ফিরতে চাই। কারণ, সেখানে আমার দুই মেয়েকে রেখে এসেছি। এই শিবিরে সব কিছুই ভালো, তবে চিকিৎসা সেবা পেতে একটু দুর্ভোগ পোহাতে হয়।”
এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, “সর্বশেষ ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে রাখাইনের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন করেছিল বাংলাদেশ। তারা বলেছে, পরবর্তী বৈঠকে তারা বিষয়টি আলোচনা করবে।”
এদিকে ২০১৮ সালের অক্টোবরের পর ১৭০ জন নারী এবং ২৯০ জন পুরুষ রোহিঙ্গা রাখাইনে ফেরত গেছেন বলে মিয়ানমার দাবি করলেও মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও প্রত্যাবাসন হয়নি।
মিয়ানমারের মতে, এই সাড়ে চারশো’র বেশি ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গার মধ্যে কোনো হিন্দু রোহিঙ্গা নেই।
তবে হিন্দু শরণার্থী নেতা শিশু শীল (৩২) বেনারকে বলেন, “গত বছর বর্ষার মৌসুমে তিন পরিবারের ১১ জন হিন্দু রোহিঙ্গা মিয়ানমার ফিরে যায়। প্রায় চার মাস পর বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হই।”