নৃশংস অপরাধের অভিযোগে মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে জার্মানিতে নতুন মামলা দায়ের

খিন মং সো, রেডিও ফ্রি এশিয়া, বার্মিজ
2023.01.25
নৃশংস অপরাধের অভিযোগে মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে জার্মানিতে নতুন মামলা দায়ের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলীয় মংডুর শহরতলির কা নিন তান গ্রামে রোহিঙ্গাদের পোড়া বাড়িঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন একজন নিরাপত্তাকর্মী। ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭।
[এপি]

রোহিঙ্গা ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমার জান্তার নৃশংস নিপীড়নের প্রতিকার চেয়ে জার্মানির ফেডারেল পাবলিক প্রসিকিউটর জেনারেলের কাছে একটি ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেছে মানবাধিকার সংগঠন ফরটিফাই রাইটস এবং মিয়ানমারের ১৬ জন নাগরিক।

‘সর্বজনীন এখতিয়ার’ নীতির অধীনে ২১৫ পৃষ্ঠার অভিযোগ এবং এক হাজার পৃষ্ঠারও বেশি সংযুক্তিসহ গত ২০ জানুয়ারিতে দাখিল করা ওই মামলায় গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের তদন্ত এবং বিচারের আহ্বান জানানো হয়েছে।

২০১৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত মিয়ানমারের নৃশংস সামরিক আক্রমণে ফলে প্রায় ৭৪০,০০০ মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

ছিন্নমূল এসব মানুষ এখন বাংলাদেশের কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে ঘিঞ্জি পরিবেশে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার পর থেকে প্রায় দুই বছরে অন্যান্য বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জান্তা কর্তৃক সংঘটিত নৃশংস অপরাধের জন্য জবাবদিহিতারও আবেদন জানানো হয়েছে এই মামলায়।

ফরটিফাই রাইটসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যাথু স্মিথ বলেছেন, অভিযোগের উদ্দেশ্য হলো জার্মান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তদন্ত শুরু করা, ভবিষ্যতের জন্য প্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং শেষ পর্যন্ত দায়ীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা।

ফরটিফাই রাইটস কর্তৃক অভিযোগ দায়েরের ঘোষণা দেওয়ার জন্য মঙ্গলবার ব্যাংককের ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাব অফ থাইল্যান্ডে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্মিথ বলেন, “অবশ্যই এখনো অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। তবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সদস্যদের এবং অপরাধের জন্য দায়ী অন্যদের কাছে এটি অবশ্যই একটি বার্তা পাঠাবে যে, তারা নিরাপদ নয়; তারা আমাদের পৃথিবীতে ভ্রমণের জন্য নিরাপদ নয়,” বলেন তিনি।

সার্বজনীন এখতিয়ার

নৃশংস অপরাধের দায়ে মিয়ানমারের জান্তাকে জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য ফরটিফাই রাইটসের এই অভিযোগ সর্বশেষ আন্তর্জাতিক বিচারিক প্রচেষ্টা। এর আগে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্য আর্জেন্টিনায় সার্বজনীন বিচারব্যবস্থার আওতায় দায়েরকৃত মামলাসহ সবগুলোই ২০১৯ সালে দায়ের করা হয়েছিল।

তবে ফরটিফাই রাইটস বলেছে, এই মামলা বর্তমানে চলমান অন্য কোনো মামলাকে অনুকরণ করবে না; বরং জান্তার অপরাধের একটি “প্রমাণিত পটভূমি" সংযুক্ত করবে।

“দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের জন্য বর্তমানে ঝুলে থাকা প্রক্রিয়াগুলোর শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য জার্মান কর্তৃপক্ষ উপযুক্ত,” এক বিবৃতিতে বলেছে মানবাধিকার সংগঠনটি।

সংগঠনটির মতে, বর্তমানে জার্মানিতে সার্বজনীন বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে একশো’র অধিক তদন্ত চলছে। তাই আশা করা যায়, প্রসিকিউটর এই অভিযোগটিও নেবেন, যদিও এই প্রক্রিয়ায় কত সময় লাগবে তা স্পষ্ট নয়।

সার্বজনীন বিচারব্যবস্থা হলো একটি আইনি নীতি যা কোনো রাষ্ট্রকে ব্যাপক নৃশংস অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করার ক্ষমতা দেয় – সে অপরাধ যেখানেই বা যাদের বিরুদ্ধেই সংঘটিত হোক না কেন। নীতিটি সাধারণত এমন গুরুতর অপরাধের জন্য প্রয়োগ করা হয়, যে অপরাধ সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে করা হয়েছে বলে গণ্য করা যায়।

ফরটিফাই রাইটস জানায়, আন্তর্জাতিক অপরাধের বিষয়ে জার্মান কর্তৃপক্ষের তদন্তকে জার্মানির বাইরে অনুষ্ঠিত বিচারব্যবস্থায় বিচারের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে৷

Rohingya2.jpeg
ব্যাংককে এক সংবাদ সম্মেলনে জার্মানির আদালতে দায়ের করা অভিযোগপত্র হাতে নিয়ে কথা বলছেন মানবাধিকার সংগঠন ফরটিফাই রাইটসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যাথু স্মিথ। ২৪ জানুয়ারি ২০২৩। [এপি]

মিয়ানমারের জনগণের জন্য স্বস্তি’

মামলা দায়েরকারী ১৬ জন ব্যক্তির প্রায় অর্ধেকই ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক নেতৃত্বাধীন ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ। বাকি অর্ধেক ২০২১ সালের পর সারাদেশে অভ্যুত্থান-পরবর্তী নৃশংসতা থেকে বেঁচে ফেরা মানুষ।

তাঁদের মধ্যে ছয় জন নারী এবং ১০ জন পুরুষ। তাঁরা ছাত্র, কৃষক, মানবাধিকার কর্মী, ব্যবসায়ী, প্রাক্তন গ্রাম প্রধান এবং গৃহিণীসহ বিভিন্ন পটভূমি থেকে আসা রাখাইন, বর্মন, চিন, কারেন, কেরেনি, সোন এবং রোহিঙ্গা জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্বকারী।

তাঁরা সবাই মিয়ানমারে সংঘটিত নৃশংসতায় প্রাণে বেঁচে গেছেন বা অপরাধ প্রত্যক্ষ করেছেন এবং অনেকেই এরপর দেশ ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

তাঁরা তাঁদের অভিযোগে এই মর্মে তথ্য প্রমাণ সংযুক্ত করেছেন যে, জান্তা কর্মকর্তারা তাঁদের অধস্তনদের ওপর অপরাধ করার দায়িত্ব দিয়েছেন, তাঁরা এই ধরনের অপরাধ সম্পর্কে জানতেন এবং অপরাধ প্রতিরোধ করতে কিংবা অপরাধীদের শাস্তি দিতে কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে (আরএফএ) ফরটিফাই রাইটসের স্মিথ বলেছেন, জার্মান কর্তৃপক্ষ অভিযোগের প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে এবং বলেছে মামলাটি চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রসিকিউটররা “আরও অভিযোগ জমা হওয়া”র হওয়ার মতো বাড়তি কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে পারেন।

প্রবীণ মানবাধিকার আইনজীবী কাই মাইন আরএফএ কে বলেছেন, সামরিক শাসনের অধীনে থাকায় “আমরা দেশে যা করতে পারছি না” সে জায়গায় এই আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে স্বাগত জানাই।

“এই মামলাটি আমাদের জনগণের জন্য উৎসাহজনক হবে ... যারা নিপীড়ন, পুড়িয়ে মারা, লুটপাট, ধর্ষণের শিকার এবং যাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংস করা হয়েছে, এটি মিয়ানমারের সেইসব জনগণের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার জন্য একটি স্বস্তিও বটে,” বলেন তিনি।

আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত গত জুলাই মাসে গাম্বিয়ার দায়েরকৃত একটি মামলার বিপরীতে মিয়ানমারের সমস্ত আপত্তি খারিজ করে দিয়েছে। ফলে ওই মামলায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার বিচারের প্রতিবন্ধকতা দূর হয়েছে। মামলাটি নিষ্পত্তি হতে কয়েক বছর লাগতে পারে।

ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মায়ো মিন অং। সম্পাদনা করেছেন জোশুয়া লিপস এবং ম্যালকম ফস্টার। বাংলা অনুবাদ: পুলক ঘটক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।